গল্প
কোল আনিসুর রহমান
১৯৮১ সালের ডিসেম্বর মাস। মালিবাগ এলাকার অধিবাসীরা ভোরে উঠে দেখলো পথের ধারে ডাস্টবিনের পাশে পড়ে আছে একটা মানুষের বাচ্চা। ডিসেম্বর মাসের শেষ রাতের শীতে নীল। যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে তা দিয়ে ঠোট দুটি শুধু একটু একটু কাঁপানো যায়। ওকে দেখে অনেকেরই সুকান্তের ছাড়পত্রের কথা মনে হতে পারে, “খর্ব দেহ নিঃসহায়” - তবে তার হাত মুষ্টিবদ্ধ নয়। তার কণ্ঠে নেই সুতীব্র চিৎকার। যে ছাড়পত্র দিয়ে ওকে পাঠানো হয়েছে সেটা জাল।
ওর বেঁচে থাকার শক্তি একজন তরুণ সাংবাদিককে মুগ্ধ করেছিলো। তিনি বাচ্চাটার দিকে ক্যামেরা তাক করে চাপ দিলেন শাটারে। নয় কোটি তিরিশ লক্ষ মাইল দূর থেকে আগত সূর্য রশ্মি শিশুটির গায়ে প্রতিফলিত হয়ে ক্যামেরার লেন্সের ভেতর দিয়ে বেঁকে আছড়ে পড়লো ফিল্মের ওপর। ছবি কোলে নিয়ে সাংবাদিক ছুটলেন পত্রিকা অফিসে। তবে শিশুটিকে তিনি পথের ধারে একা ফেলে যাননি। ওর পাশে একটা নেড়ি কুকুর ছিলো। গায়ের প্রায় সব লোম ওঠা কুকুরটা ওর পাশে এমন ভঙ্গি করে বসে ছিলো যেন পাহারা দিচ্ছে। সে মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে বাচ্চাটাকে শুঁকে শুঁকে দেখে। শুঁকতে গিয়ে একবার তো সে ওর গালটাই চেটে দিলো। কত বড় স্পর্ধা ! যে গালে মানুষের চুমু খাবার কথা তুই কুকুর হয়ে সেই গাল চাটলি! শিশুর কোমলতা মানুষের বুকে মায়া জাগানোর জন্য। কিন্তু এ শিশুটি তা পারলোনা। পাপের ভয়, খরচের ভয়, সমাজের ভয় সব মায়াকে এক ধরণের ঘৃণায় পরিণত করলো। যে দেখে সেই একটু চমকায়! মানুষের অধঃপতনের কথা ভেবে শিউরে ওঠে। কলি কালে আারো কত কি দেখতে হবে তা নিয়ে জল্পনা কল্পনা করে। কেয়ামতের নিকটবর্তী ভেবে ভীত হয় কিন্তু হাত বাড়িয়ে কেউ ওকে বুকে তুলে নিল না। কেউ দিলোনা শীতের বস্ত্র। কোনো স্নেহময়ী নারী তার স্তন ছোয়ালোনা ওর ক্ষুধার্ত ঠোটে। কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতায় অনভ্যস্ত একটা নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী নিজের পেটের চিন্তা ভুলে বসে রইলো ওর পাশে। মানুষ পাপকে ভয় না পেলেও পাপের সন্তানকে ভয় পায়। কুকুরদের কোনো পাপ পুণ্য নেই।
খালেক রিক্সা চালিয়ে ঐ পথ দিয়ে যাচ্ছিলো। সে পাপী। তাই সম্ভবতঃ শিশুটিকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে পিতৃত্ব জেগে উঠেছিলো প্রাণে। সে রিক্সা থামিয়ে ঝুঁকে পড়ে দেখলো বাচ্চাটাকে। চঞ্চল হয়ে উঠলো কুকুরটা। লেজ নাড়তে লাগলো দ্রুত। গায়ে শক্তি নেই। লেজ নাড়তে কষ্ট হচ্ছিলো ওর। খালেক গায়ের জামা খুলে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে কোলে তুলে নিলো। অনেকেই তখন এগিয়ে এসে ভিড় করে দাঁড়ালো। এটা ওটা দিয়ে সাহায্য করলো। গায়ের চাদর খুলে দিলো একজন। একটুখানি উদ্যোগের জন্য কত শুভ-ইচ্ছা যে চাপা পড়ে থাকে ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। বাচ্চাটাকে কিভাবে রিক্সায় করে নিয়ে যাওয়া যায় ভাবছিলো খালেক। একটা টোকাই ছেলে এগিয়ে এসে বললো “আমারে দেন, আমি কোলে নিয়া বসি।” খালেক রিক্সা চালাতে লাগলো। কুকুরটা ছুটলো পিছে পিছে তবে বেশী দূর যেতে পারেনি। মালিবাগ মোড় পার হবার সময় একটা গাড়ীর ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়লো রাস্তার পাশে। ক্যাঁক করে একটা শব্দ হলো, তারপর সব শেষ। ওর দুর্বল শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে গেছে। উচিৎ শিক্ষা হয়েছে ওর। শিশুরা ফেরেস্তার মত। আর কখনো চাটবি ফেরেস্তার গাল?
খালেক ধানমন্ডিতে একটা বাড়ীর সামনে রিক্সা থামালো। টোকাই ছেলেটাকে রিক্সার কাছে থাকতে বলে বাচ্চাটাকে নিয়ে লোহার গেট ঠেলে ঢুকে গেল প্রাচীর ঘেরা বাড়ীর ভেতরে। বাড়ীর সামনে একটা নতুন গাড়ী চক্ চক্ করছে। ভেতরে ড্রাইভার বসেছিলো; খালেককে দেখে বেরিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, “কি খবর খালেক মিঞা, কি মনে করে?” জী, খবর ভালো, তাড়াতাড়ি আম্মারে খবর দেন, তার জন্য একটা জিনিষ আনছি। “কি জিনিষ?” বলে ড্রাইভার আব্দুল কাদের খালেকের দিকে এগিয়ে গেল, দেখালো কি এনেছে। কিছুক্ষণ কথা হলো দুজনের মধ্যে তারপর দ্রুত পায়ে ঢুকে গেল বাড়ির ভেতরে এবং ফিরে এলো একজন মাঝ বয়েসি মহিলাকে সাথে নিয়ে। ঘটনাটি তিনি কাদেরের কাছে সংক্ষেপে শুনেছেন তাই খালেককে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই বললেন, “অসম্ভব আমি রাখতে পারবো না।” তিনি কাছে এসে বাচ্চাটাকে দেখলেন। সে তখন ছোট্ট ছোট্ট মায়া ভরা চোখ মেলে তাকিয়ে আছে। তবে সে মায়া রাবেয়া খাতুনকে তার সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারলোনা। আসলে, ভালোবেসে না দেখলে অনেক সৌন্দর্য দেখতে পাওয়া যায় না। খালেককে তিনি বিদায় করে দিলেন। খালেক চলে যাচ্ছিলো। রাবেয়া খাতুন ওকে একটু থামতে বলে বাড়ীর ভেতর ঢুকে গেলেন। একটু পরে ফিরে এসে খালেকের হাতে একটা মোটা অংকের নোট গুঁজে দিয়ে বললেন, “ওকে কোনো এতিম খানায় দিয়ো এসো, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।” খালেককে বাচ্চা কোলে নিয়ে ফিরতে দেখে টোকাই ছেলেটা জানতে চাইলো -
: বাচ্চা রাখে নাই? : না। : আমি আগেই বুঝছিলাম রাখবো না। : ক্যামনে বুঝলি? : বড়লোকের আত্মা ছোট। : চুপ থাক। ছোট মুখে বেশী বড় কথা।
খালেকের ধমক খেয়ে টোকাই চুপ করে বাচ্চা কোলে নিয়ে বসে রইলো। এবার রিক্সা চলেছে মিরপুর মাজারের দিকে। মাজারের কাছে ওর অস্থায়ী ডেরার সামনে রিক্সা থামালো খালেক। জায়গাটা পাকা রাস্তা থেকে অনেকটা ভেতরে। কাঁচা এবড়ো থেবড়ো রাস্তা দিয়ে রিক্সা টেনে নিয়ে যেতে হয়। একদিকে উঁচু দেয়াল, অন্যদিকে পচা নর্দমা । দেয়ালের ধার ঘেঁষে সারি সারি ছাপরা ঘর। এই অসময়ে বাবাকে ফিরতে দেখে খুশি হয়ে ছুটে এলো ওর চার বছরের ছেলে কিষাণ। প্রতিবেশীর সাথে কথা বন্ধ করে এগিয়ে এলো খালেকের বউ মরিয়ম, পেছনে দেড় বছরের মেয়ে সখিনা। খালেক অনেক দূর রিক্সা চালিয়ে ক্লান্ত। মনের অবস্থাও ভালোনা তাই বেশী ভূমিকা না করে বাচ্চাটাকে মরিয়মের কোলে দিয়ে বললো, “ধর, এইডারে পাল”। মরিয়মের বিস্ময় প্রকাশের অদ্ভূত ক্ষমতা আছে। সে এমন ভাবে হায় হায় করে উঠলো যেন কেউ তার কোলে একটা ভুতের বাচ্চা তুলে দিয়েছে। মরিয়ম চোখ কপালে তুলে বললো, “হায় হায় এইডা তুমি কার বাচ্চা নিয়া আইছো”! খালেক রিক্সা চালাতে চালাতে মরিয়মের প্রথম ধাক্কাটা যাতে সহজ হয় সে রকম একটা গল্প তৈরি করেছিলো। এক বন্ধুর ছেলে। মার শরীর খুব খারাপ। এখানে দেখার কেউ নাই তাই কিছুদিন বাচ্চাটাকে পালতে হবে। তার পর ধীরে ধীরে যখন মায়া পড়ে যাবে তখন আসল কথাটা বলা যাবে। কিন্তু খালেক মুখ খোলার আগেই টোকাই ছেলেটা তার সব পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে বলে উঠলো, “রাস্তার ধারে পইড়া ছিলো”। খালেকের মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সে প্রচণ্ড একটা চড় বসিয়ে দিলো টোকাই ছেলেটার গালে। “তুই সব সময় এত ফডর ফডর করিস ক্যান?” চড় খেয়ে ছিটকে পড়লো ছেলেটা। একটু দূরে গিয়ে মাটির উপর বসে কাঁদতে লাগলো। যাকে কেউ ভালোবাসেনা তার কাঁদার কোনো মানে হয় না। অনর্থক সময় নষ্ট। ওর বয়স কম। এই পৃথিবীর অনেক নিয়ম কানুন এখনো ওর শেখার বাকি। হয়তো একটা ভালো কাজে সহযোগিতা করতে পারার জন্য ওর খুব আনন্দ হচ্ছিলো, হয়তো একটু আধটু গর্ব জমেছিলো মনে। অহংকার পতনের মূল। সবার নিচে যার স্থান; আর পতনের সম্ভবনা যার নেই; গর্ব আর অহংকারে তার কি প্রয়োজন! তাই সম্ভবতঃ বিধাতা ওর জন্য এই গুরু দণ্ডের ব্যবস্থা করেছিলেন।
এতক্ষণে লোকজন এসে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে। টোকাই ছেলেটার কথা শুনে মরিয়ম ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। সে ছি ছি করে ঘৃণা প্রকাশ করতে করতে বললো, “আমি পারুম না”। মরিয়ম বাচ্চাটিকে পথের উপর নামিয়ে রেখে ঢুকে গেল ছাপরার ভেতরে। খালকের মাথায় রক্ত চড়েই ছিলো। সে ছুটে গিয়ে চুল ধরে টেনে হিঁচড়ে তাকে বের করে আনলো ছাপরার ভেতর থেকে। গালাগালি দিলো অকথ্য ভাষায়। “মানুষ হাঁস-মুরগির বাচ্চা পালে তুই মানুষের বাচ্চা পালবার পারবিনা কেন? নে-, উঠা-, বাচ্চা কোলে নে-”। হাঁস-মুরগির বাচ্চা পালা আর মানুষের বাচ্চা পালা যে এক জিনিষ নয় তা গলার স্বরে বুঝিয়ে দেবার জন্যই সম্ভবতঃ চিৎকার করে জবাব দিলো মরিয়ম, “আমি পা-রু-ম- না-”। ওর কথা শুনে খালেকের রাগে উন্মাদ হয়ে যাবার কথা কিন্তু মরিয়মের চিৎকার শুনেই হোক কিংবা নিজের বোকামির কথা ভেবেই হোক কেন যেন রাগ করলোনা খালেক। সে বাচ্চাটাকে মাটি থেকে তুলে নিয়ে মরিয়মের সামনে এগিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো, “এই দেখ কেমন কচি বাচ্চা, তাড়াতাড়ি ওর মুখে কিছু দে”। খালেকের নরম গলা শুনে মরিয়মের চোখে পানি এলো। সে কোলে নিলো বাচ্চাটাকে। খালেক ওর পিঠে হাত বুলিয়ে আদর করতে করতে বললো, “যত্ন কইরা মানুষ কর। একদিন ওই তোর যত্ন করবো”। মরিয়মের চোখে পানি, কোলে বাচ্চা।
পরিস্থিতি একটু নরম দেখে একজন বয়স্ক মহিলা এগিয়ে এলো। তাকে সবাই খালা বলে ডাকে। একদিন হয়তো সত্যি সত্যি সে কারো মায়ের ছোটো বোন হতো। কিন্তু আজ আর সে কারো কিছু হয় না। বাপ মায়ের দেওয়া নামটাও হারিয়ে গেছে। এখন খালাই তার নাম। খালা মরিয়মকে টেনে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে সান্ত্বনা আর উপদেশের সুরে নিচু গলায় যা বললো তার সারমর্ম খুব সংক্ষিপ্ত। কি প্রয়োজন সকাল বেলায় ঝগড়া বাঁধিয়ে মার খাবার। তার কাজ সে করেছে, এখন তোমার কাজ তুমি করো। মায়ের বুক ছাড়া এত ছোট বাচ্চা কয়দিনই বা বাঁচবে। আর যদি তাড়াতাড়ি ঝামেলা মুক্ত হতে চাও সে ব্যবস্থাও আছে। বুকের ভেতরটা ধক করে উঠলো মরিয়মের। কি বলতে চায় খালা!
(প্রথম প্রকাশঃ প্রবাহ, জুন ১৯৯৭)
আনিসুর রহমান, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|