গল্প
ডাইরি আনিসুর রহমান
বাকি জীবনের জন্য একসাথে তেপ্পান্নটা ডাইরি কিনেছিলেন কলিম সাহেব, সাতাশ বছর বয়েসে। ঠিক দোকান থেকে কেনা নয়। তার নিজের প্রেসে ছাপানো। প্রতিটি ডাইরি চামড়া দিয়ে বাঁধাই করা। প্রতিটির ওপরে সোনালি অক্ষরে লেখা আলাদা আলাদা সাল। প্রতিটির ভেতরে প্রতিদিনের জন্য একটি করে পাতা। প্রতি পাতায় তারিখ এবং বারের নাম। বাজার থেকে কেনা ডাইরির মত। জীবনের একটি দিনের জন্য একটি করে পাতা।
তার ডাইরি লেখার নেশা শুরু হয় পনেরো বছর বয়স থেকে। ছোট চাচা দেশে বেড়াতে এসে উপহার হিসাবে একটা ডায়রি হাতে দিয়ে বলেছিলেন- লেখার অভ্যাস কর। ডাইরি যে এত সুন্দর হতে পারে আগে জানা ছিল না। নরম কালো চামড়ায় বাঁধানো একটা ডাইরি। কোনাগুলো ফরটিন ক্যারেট গোল্ড দিয়ে মোড়ানো। ভেতরের পাতাগুলো দামী- দেখলেই বোঝা যায়। প্রতিদিন কিছু কিছু লেখার চেষ্টা করতেন তিনি। একদিন কিছু না লিখলে মনে হতো একটা পাতা নষ্ট হলো। ডাইরির পাতা অবশ্য জীবনের পাতার মত নয়। এখানে মানুষ অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যতের মধ্যে বিচরণ করে খুব সহজেই। এখানে পরিবর্তন করা যায় অতীতকে- দেখা যায় ভবিষ্যৎ।
কবে কি ঘটেছে আর কবে কি ঘটবে তা দিয়ে ভরে উঠতে লাগলো ছোট চাচার দেয়া ডাইরিটার পাতার পর পাতা। সমস্যা দেখা দিলো বছরের শেষ দিকে এসে। বড় বোনের বিয়ে ঠিক হয়েছে- বাইশে জানুয়ারি। কোন পাতায় লিখবেন তিনি এই আনন্দ আর বেদনার দিনটির কথা! আগামী বছরের ডাইরি এখনো বাজারে আসেনি। আহা, সে ডাইরিটাও যদি এই ডাইরিটার মত হতো। ছোট চাচাকে চিঠি লিখতে ইচ্ছা হলো। ওদেশে নিশ্চয়ই প্রতি বছর এমন ডাইরি বাজারে আসে। লেখা হয়নি চিঠিটা। মনে হয়েছে থাক- এমন জিনিস একটা থাকাই ভাল। মাস খানেক অপেক্ষা করে বাজার থেকে একটা সাধারণ ডাইরি কিনে নিয়েছিলেন তিনি। বড় বোনের বিয়ের তারিখটা লিখতে গিয়ে চোখে পানি এসে গিয়েছিল। এই বাড়ি, এই ঘর, এই বাগান, এই ফুলদানী সব থাকবে কিন্তু সেই প্রিয় কণ্ঠের ‘খেতে আয়’ ডাকটা আর শোনা যাবে না।
প্রতি বছরের শেষ দিকে এসে একই সমস্যা হতে লাগলো। ঘটনা আছে কিন্তু লেখার পাতা নেই। দুলাভাই পিএইচডি করতে আপাকে নিয়ে বিদেশে যাবার সময় বলে গেলেনে তিন বছর পরে ফিরবেন। তারিখটা এখনো জানা নেই- তবু খুব ইচ্ছে হচ্ছিল- আহা যদি সে বছরের ডাইরিটা থাকতো, তাহলে অনুমান করে হলেও একটা পাতায় লিখে রাখা যেত ‘আজ বড় আপা দেশে ফিরবে।’ সারা জীবনের সবগুলি ডাইরি একসাথে কেনার বাসনা এ ভাবেই প্রথম জেগেছিল কলিম সাহেবের মনে।
লাইব্রেরি ঘরে একটা লম্বা টেবিলের ওপর দুই দিকে বুক স্ট্যান্ড দিয়ে পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখা হয়েছে তেপ্পান্নটি ডাইরি। তার সমগ্র জীবন। কোনো বড় কাজ কবে করবেন তা দিন তারিখ দেখে, চিন্তা ভাবনা করে সেই বছরের ডাইরিতে লিখে রাখেন তিনি। এতে তার জীবনটা খুব গোছানো হয়ে গিয়েছিল। এক পাতা থেকে অন্য পাতায়, এক ডাইরি থেকে অন্য ডাইরিতে প্রবাহিত হয়েছে জীবন। নতুন প্রেস যেদিন চালু করবেন ভেবেছিলেন সেদিনই চালু হয়েছে। এনগেজমেন্ট, বিয়ে, হানিমুন- সব কিছুই পরিকল্পনা মাফিক ঘটেছে। পূর্ব প্রস্তুতির অনেক সুবিধা আছে। একবার ডাইরিতে লেখা হয়ে গেলে বহু আগে থেকে তার সমস্ত প্রচেষ্টা সেই দিকে নিবদ্ধ থাকে। তাই সারা জীবনে তার লেখা ভুল হয়নি কখনো শুধু দুই বার ছাড়া। প্রথম সন্তানের জন্মের সময় ডাক্তার যেদিন তারিখ দিয়েছিলেন সে দিনই সন্ধ্যায় ব্যথা উঠেছিল পারুলের। রাত তিনটায় জন্ম হয় নদী’র। হিসাবের দিন থেকে মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরে- ডাইরির অন্য একটি পাতায়।
নদীর জন্মের পর থেকেই দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন তার স্ত্রী। এক সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখেন পারুল বিছানায় শুয়ে। ‘শরীরটা কেমন করছে তাই একটু শুয়ে আছি’- বলে ওঠার চেষ্টা করতে গিয়ে পড়ে গেল পারুল। ডাক্তার বাড়িতে এসে দেখে গেলেন। শুরু হলো নানা পরীক্ষা নিরিক্ষা। অনেকদিন ভুল চিকিৎসায় পর ধরা পড়লো লিউকেমিয়ায় ভুগছে পারুল। ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন- বেশী হলে আর একমাস। নদীর বয়স তখন মাত্র দুই বৎসর; তাদের প্রথম এবং শেষ সন্তান।
পারুলকে হাসপাতালে ভর্তি করা হলো। কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছেন না কলিম সাহেব। সারা রাত নিদ্রাহীন কাটিয়ে ভোরের দিকে লাইব্রেরীতে ঢুকলেন তিনি। আজ পনের তারিখ। পরের মাসের পনের তারিখের পাতাটা খুল কিছু লেখার চেষ্টা করলেন। কিছুই লিখতে পারলেন না তিনি। শুধু কলমটা যেখানে কাগজটাকে ছুঁয়েছিল সেখানে একটা কালো দাগ স্থায়ী ভাবে অঙ্কিত হয়ে রইলো।
দিন দিন আরো দুর্বল হয়ে পড়ছে পারুল। বর্ষা শেষে আকাশে দেখা দিয়েছে শরতের মেঘ। সেদিকে তাকালেই মনে হয় মেঘের সাথে ভেসে যাই- দূরে কোথাও- অনেক দূরে। সারাটা বিকেল আকাশের মেঘ দেখে কাটালেন কলিম সাহেব। সন্ধ্যায় হাসপাতালে পারুলকে দেখতে এসে মনে হলো সময় শেষ হয়ে এসেছে। সে রাতেই মারা গেল পারুল। কলিম সাহেবের ডাইরির সেই কালো দাগটি আসতে তখনো আরো দুই দিন বাকি।
স্ত্রীর মৃত্যুর পর আর বিয়ে করেননি কলিম সাহেব। নদীকে মানুষ করেছেন। বিয়ে দিয়েছেন। নাতি নাতনি হয়েছে। তাদের নিয়ে আনন্দে কাটে তার সময়। দুপুরে বাড়িতে কোনো হৈ চৈ থাকে না। কলিম সাহেব এই সময়টা লাইব্রেরিতে গিয়ে ডাইরিগুলোর সামনে একটা ইজি চেয়ার বসে থাকেন। নিজের সমগ্র জীবনটাকে একসাথে দেখতে খুব ভালো লাগে তার। কিন্তু ডাইরি ফুরিয়ে যাচ্ছে বলে মনটা কেমন যেন খারাপ হয়ে যায় বার বার। লেখার মত আর কিছু খুঁজে পান না তিনি। ডাইরি ফুরিয়ে গেলে কি ঘটনাও শেষ হয়ে যায়! একদিন একদিন করে গড়িয়ে চলেছে সময়। শেষ ডাইরিটা ধরেছেন তিনি ছয় মাস আগে, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছেন শেষ পাতাটার দিকে। ডাইরি লেখা যখন শুরু করেছিলেন তখন কত ঘটনা ছিল কত পরিকল্পনা ছিল- তাজমহল, হিমালয়, পিরামিড সবই হয়েছে তার পরিকল্পনা মত, শুধু একটি জন্ম- আর একটি মৃত্যু ছাড়া।
(প্রথম প্রকাশঃ সিডনি থেকে প্রকাশিত মাসিক পত্রিকা প্রবাহ, মে ২০০১)
আনিসুর রহমান, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|