এত ভাষার দরকার কি? আনিসুর রহমান
একটা দেশে বেড়াতে গিয়ে সে দেশের ভাষা না জানা যে কি সমস্যা সেটা চীনে গিয়ে হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছি। ওদের ভাষাটা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ভাষার চেয়ে এতটাই আলাদা যে আকার ইঙ্গিত ও খুব একটা কাজে লাগে না। আমাদের ছোট্ট গ্রুপের কয়েক জন কিছু কেনাকাটা করতে গেল। আমরা বাকিরা শপিং সেন্টারের ভেতরেই একটা ক্যাফেতে ঢুকলাম। ওরা ফিরলে একসাথে বসে কিছু খাবো। একটা চাইনিজ মেয়ে এসে মেনু দিয়ে গেল। আমরা অর্ডার দিচ্ছিনা দেখে বেশ কয়েকবার এসে তাগাদা দিল। পরে একটা চাইনিজ ছেলেও এলো সাথে। অনেক চেষ্টা করেও তাদের বোঝাতে পারলাম না যে আমরা আমাদের বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছি। ওরা এলে অর্ডার দেবো। ওদের মুখ চোখ দেখে মনে হলো কিছু অর্ডার না দিয়ে বসে আছি বলে তারা বিরক্ত হচ্ছে। উঠে যাবো কিনা ভাবছি এমন সময় চাইনিজ ছেলেটা পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে একটা ট্রান্সলেট এপ ওপেন করে এগিয়ে দিল। আমরা কি বলতে চাই তা ইংলিশে টাইপ করে দিলাম, পাশে চাইনিজ লেখা ভেসে উঠলো। ফোনটা ওর হাতে ফিরিয়ে দিতেই দু’জনের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ওরা চলে গেল আর আমাদের বন্ধুরা শপিং করে ফিরে না আসা পর্যন্ত তারা অর্ডার নেবার জন্য এদিকে আসেনি। মোবাইল টেকনোলজির গুণে চীনাদের আতিথেয়তা সম্পর্কে একটা ভুল ধারণা হৃদয়ে বদ্ধমূল হবার সুযোগ পায় নি। তাই মাঝে মাঝে মনে হয় পৃথিবীতে এত ভাষার দরকার কি! সবাই এক ভাষায় কথা বললে কি মজাই না হতো!
মানুষে মানুষে যোগাযোগ, ভাল ভাবে বেঁচে থাকার জন্য এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে আরবি, ফারসি, হিন্দি, বাংলা এবং অন্যান্য ভাষা মিলে মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষে একটা নতুন ভাষা তৈরি হয়েছিল। যার নাম উর্দু। মোগল ব্যারাকে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা সৈন্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের জন্য যে শব্দগুলি মোটামুটি সবাই বোঝে সেগুলিকে নিয়ে ধীরে ধীরে সৃষ্টি করেছে এই ভাষা।
১৯ শতকে এসপেরান্তো নামে একটা ভাষাও সৃষ্টি করা হয়েছে ইউরোপে। উদ্দেশ্য ছিল পৃথিবীর সব মানুষের জন্য মাতৃভাষার পাশাপাশি একটা দ্বিতীয় ভাষা তৈরি করা যেটা শেখা সহজ, বানান এর ঝামেলা নেই এবং ব্যাকরণও খুব সহজ এবং ব্যতিক্রম হীন। গুগল ট্রান্সলেটে পৃথিবীর সব ভাষার সাথে এসপেরান্তো ও আছে। সেখানে একদিকে বাংলা আর অন্যদিকে এসপেরান্তো নিয়ে লিখলাম “তোমার নাম কি”, বেরিয়ে এলো অনুবাদ “কিয়া এস্তাস ভিয়া নোমো”। অনুমান করা হয় পৃথিবীতে প্রায় এক কোটি মানুষ দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে এসপেরান্তো বলতে পারে।
ভাষাভাষী মানুষের সংখ্যা হিসাবে পৃথিবীর প্রথম দশটি ভাষা হলোঃ চাইনিজ (ম্যান্ডারিন), স্প্যানিশ, ইংলিশ, হিন্দি, আরবি, পর্তুগিজ, বাংলা, রুশ, জাপানিজ এবং পাঞ্জাবী। এর সাথে যদি সবার দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে এসপেরান্তো যোগ হয় তাহলে, আগের প্রশ্নে ফিরে আসি - পৃথিবীতে এত ভাষার দরকার কি? বর্তমান বিশ্বে প্রায় সাত হাজার ভাষা রয়েছে বলে অনুমান করা হয়। এদের প্রথম স্থানে আছে ম্যান্ডারিন চাইনিজ। ১২০ কোটি মানুষ এই ভাষায় কথা বলে। সবচেয়ে কম ভাষাভাষী আছে এমন ভাষার একটা তালিকা খুঁজতে গিয়ে “তালাওয়া (Talawa) নামে একটা ভাষার নাম পেলাম। এক সময় ক্যানাডার উত্তরাঞ্চল এবং আলাস্কায় এই ভাষাভাষী মানুষেরা বাস করতো। বর্তমানে এই ভাষা জানা মানুষের সংখ্যা মাত্র ১ জন। কথাটা পড়ে কেন জানি মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল? একজন মানুষ, কিছু বলার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে অথচ পৃথিবীর কেউ তার ভাষা বুঝতে পারছে না! কী ভয়াবহ ব্যাপার!
এর পর থেকে ভাষার প্রতি আমার মনোভাব কিছুটা হলেও পাল্টেছে। কেন পৃথিবীর ভাষাগুলিকে হারিয়ে যেতে দেয়া উচিত নয় সে ব্যাপারে ইন্টারনেটে বেশ কিছু তথ্য ঘেঁটেছি। এসবের সারমর্ম আমার উপলব্ধির ভাষায় এখানে তুলে ধরলাম।
প্রায় দুই লক্ষ বছর আগে হোমো গোত্রের একটি প্রজাতি হিসেবে আধুনিক মানুষ (হোমো সেপিয়ান) এর উদ্ভব। এর পেছনে ভাষার একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। ভাষার কারণেই মানুষ সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে অনেক বড় বড় কাজে হাত দিতে পেরেছে যা অন্য প্রাণীরা পারেনি।
ভাষা শুধু জীবিত মানুষদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম নয়। যুগ যুগ ধরে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসকারী মানুষ তাদের রচিত ছড়া, গল্প, লোকো-গাঁথার মাধ্যমে তাদের অর্জিত জ্ঞান-বিজ্ঞান, নীতি কথা, উপদেশ, পরামর্শ পৌঁছে দিয়েছে অনাগত ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে। মানুষ লিখতে শিখেছে মাত্র হাজার পাঁচেক বছর আগে। এখনো পৃথিবীর অর্ধেকের মত ভাষার কোন লিখিত রূপ নেই। তার মানে যুগ যুগ ধরে মুখের কথাই ছিল অতীতের সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম। নানা কারণে ধীরে ধীরে অনেক ভাষা হারিয়ে গেছে এবং এখনো যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে বর্তমান শতাব্দী শেষ হবার আগেই এখনো টিকে থাকা পৃথিবীর সাত হাজার ভাষার অর্ধেক হারিয়ে যাবে!
একটা ভাষা হারিয়ে গেলে একটা মানব গোষ্ঠীর তিল তিল করে সঞ্চিত শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, জ্ঞান, বিজ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা - সব হারিয়ে যায়। আজকের ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকদের কাছে পৃথিবী বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের শিল্প সাহিত্য ও লোক-গাঁথার গুরুত্ব অপরিসীম। শুধু ঐতিহাসিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিকরাই নয় আজকের বিজ্ঞানীদের কাছেও পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লিখিত ইতিহাসের গুরুত্ব আছে। ১৯৪৬ সালে কার্বন-১৪ ডেটিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। এই পদ্ধতি ব্যাবহার করে বিজ্ঞানীরা হাজার হাজার বছরের পুরানো কোন প্রাণী বা উদ্ভিদের বয়স নির্ণয় করতে পারেন। কিন্তু এই পদ্ধতি কতখানি সঠিক তা নির্ণয় করার জন্য এর উদ্ভাবক উইলার্ড লিবি প্রাচীন মিশরের ইতিহাস ঘেঁটেছিলেন। ফারাও ৩য় সানুসরেট এর শব যাত্রার জন্য নির্মিত একটি নৌকার একটুকরা কাঠের কার্বন-১৪ ডেটিং করে তিনি তার পদ্ধতি কতখানি সঠিক তা প্রমাণ করেছিলেন। ফরাসি ভাষাতত্ত্ববিদ জন-ফ্রান্সোয়াজ শ্যাম্পোলিন কে ধন্যবাদ, তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে আজকের মানুষেরা প্রাচীন মিশরের বিলুপ্ত ভাষা পড়তে পারে। পৃথিবীর কোন ভাষা হারিয়ে যাক তা আজ আর কারো কাম্য নয়। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস তারই সাক্ষ্য বহন করে!
একুশে একাডেমি অস্ট্রেলিয়ার বই মেলা ২০১৯ এর বিশেষ সংকলনে প্রকাশিত
আনিসুর রহমান, সিডনি, অস্ট্রেলিয়া
|