DNA মেমোরি এবং আমাদের পূর্ব-পুরুষ! আনিসুর রহমান
হাজার হাজার বছর আগে আমাদের পূর্ব-পুরুষ কোথায় বাস করতো তা কার না জানতে ইচ্ছা করে। যদি খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় আমাদের পূর্ব পুরুষ অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছিল তাহলে কি মজার একটা ব্যাপার হবে! এই যে আমরা অস্ট্রেলিয়ায় এসে বসতি গেড়েছি এটা তখন আর বিদেশে আসা থাকবে না বরং আবার পূর্ব-পুরুষের ভিটায় ফিরে আসার মত একটা ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে! শেকড় সন্ধানী মানুষের কৌতূহল নিবৃত করতে এগিয়ে এসেছেন শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিজ্ঞানী। তাদের উদ্ভাবিত পদ্ধতির নাম DNA GPS. গাড়িতে GPS লাগিয়ে আমরা যেমন অচেনা পথ ধরে অজানা ঠিকানায় পৌঁছে যাই। এই পদ্ধতিও তেমনি আমাদের নিয়ে যেতে পারে পূর্ব-পুরুষের ঠিকানায়। নামকরণটা সত্যিই সুন্দর বলতে হবে। তবে গাড়িতে লাগানো GPS এর মত এটা কোন যন্ত্র নয় DNA GPS একটি জটিল তথ্য বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে হাজার বছর আগে আমাদের পূর্ব-পুরুষ কোন অঞ্চলে এমনকি কোন কোন ক্ষেত্রে কোন গ্রামে বাস করতো তাও নির্ণয় করা যায়।
আমাদের দেহ প্রায় ৩৪ লক্ষ কোটি কোষ দিয়ে তৈরি। এর প্রতিটি কোষে বিভিন্ন দৈর্ঘ্যের ৪৬টি পেঁচানো মই এর মত জিনিস আছে যার বৈজ্ঞানিক নাম DNA. আমাদের দেহের তুলনায় কোষগুলি অনেক ছোট। খালি চোখে দেখা যায় না। তার ভেতর আবার ৪৬টা মই সেগুলো তাহলে কত ছোট! কিন্তু ছোট হলে কি হবে DNA এর ক্ষমতা বিস্ময়কর! আজকাল আমরা প্রায় সবাই ডিজিটাল ক্যামেরা ব্যাবহার করি। এসব ক্যামেরায় ছোট্ট একটা মেমোরি কার্ড ঢোকানো থাকে যার মধ্যে গাদা গাদা ফটো ভরে রাখ যায়। আমাদের কোষের DNA ও এক ধরনের মেমোরি কার্ড। তবে সাইজে অনেক ছোট। অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা কঠিন।
গর্ভধারণের সময় আমরা মা'র কাছ থেকে ২৩টা আর বাবার কাছ থেকে ২৩টা মোট ৪৬ মেমোরি কার্ড উত্তরাধিকারসূত্রে পাই। এর পর শুরু হয় আমাদের বড় হবার পালা অর্থাৎ কোষ বিভাজন। একটা থেকে দুইটা, দুইটা থেকে চারটা, চারটা থেকে আটটা, ১৬, ৩২, ৬৪ এভাবে শত কোটি, হাজার কোটি, লক্ষ কোটি! প্রতিবার কোষ বিভাজনের সময় মেমোরি কার্ডগুলোও কপি হয় যায়; ছড়িয়ে যায় দেহের প্রতিটি কোষে কোষে। DNA মেমোরিতে আমাদের শরীরের যে ডিজাইন স্টোর করা আছে আমরা ধীরে সেই রূপ ধারণ করি। আমরা নারী বা পুরুষ হই, আমাদের চেহারা, নাক মুখ, চুল, গায়ের রঙ - সবকিছু নির্ধারিত হয় DNA মেমোরি দ্বারা।মাতৃগর্ভের মেয়াদ শেষ করে আমরা ভূমিষ্ঠ হই। বেড়ে উঠি এবং আমাদের DNA মেমোরির ব্যাকআপ রেখে যাই আমাদের ছেলে-মেয়েদের শরীরের কোষে কোষে। আমরা মরে যাই কিন্তু DNA মরে না। আমাদের পূর্ব-পুরুষের ইতিহাস সেভ হয়ে থাকে আমাদের ছেলে-মেয়েদের DNA মেমরিতে।
মানব দেহের DNA মেমরির সমস্ত কেমিক্যাল কোড লিপিবদ্ধ করার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান HGP'র হাতে। তারা ২০০৩ সালে এই কাজ শেষ করেছে। অত্যন্ত জটিল এই কাজটি করতে তাদের সময় লেগেছে প্রায় বিশ বছর। কম্পিউটার মেমোরিতে তথ্য লেখা হয় মাত্র দু'টো অক্ষরে - শূন্য এবং এক। আমার নাম (Anisur Rahman) কম্পিউটার মেমোরিতে লেখা হবে এই ভাবে: 01000001 01101110 01101001 01110011 01110101 01110010 00100000 01010010 01100001 01101000 01101101 01100001 01101110.
DNA মেমোরি লেখা হয় চার অক্ষরে: A, T, C এবং G - প্রায় ৬০০ কোটি অক্ষর দিয়ে লেখা হয়েছে আমাদের পূর্ব-পুরুষের ইতিহাস! কিন্তু লেখা থাকলে কি লাভ যদি আমরা তা পড়তে না জানি। কেউ যদি একটা জার্মান বই হাতে ধরিয়ে দেয় তাহলে যে অবস্থা হবে পরিস্থিতিটা সেরকম। অক্ষর গুলো ইংরেজির মতই কিন্তু জার্মান ভাষা না জানলে পড়ে কিছু বোঝার উপায় নেই। ভাষাটাকে বুঝতে হবে। সম্প্রতি এই কাজটিই করেছেন ড. এরান এলহাইক এর নেতৃত্বে শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা। তারা সারডেনিয়া এবং প্রশান্ত মহাসাগরের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে আগত জনগোষ্ঠীর DNA পরীক্ষা করে অত্যন্ত আশাব্যঞ্জক সাফল্য অর্জন করেছেন। তারা ৯০% ক্ষেত্রে তাদের পূর্ব-পুরুষের গ্রাম চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছেন।
আমাদের কৌতূহলী মনের খোরাক মেটানো এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। তবে শুধু কৌতূহল নিবারণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে না DNA GPS - ইতিহাসের অনেক প্রতিষ্ঠিত সত্যকে ওলট-পালট করে দেবার ক্ষমতা রাখে এই প্রক্রিয়া। স্ফিংস কারা তৈরি করেছিল? আমরা আর্য না অনার্য? প্যালেস্টাইনে কাদের অধিকার বেশী? এমন অনেক প্রশ্নের জবাব মিলতে পারে এই প্রক্রিয়ায়!
|