বিদায় শারমিন পাপিয়া! আনিসুর রহমান
সিডনির উদ্যমী রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী শারমিন পাপিয়া গত ২৪ শে জানুয়ারি তাঁর আত্মীয়-স্বজন এবং প্রিয়জনদের শোক সাগরে ভাসিয়ে লিভারপুল হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল মাত্র ৫৪ বৎসর। এমন হাস্যজ্জল, বন্ধুবৎসল এবং সঙ্গীত-প্রাণ একজন মানুষ এমন অকালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমাবেন তা মেনে নেওয়া সহজ নয়। আমরা তাঁর পরিবার পরিজনদের জানাই গভীর সমবেদনা।
শারমিন পাপিয়া ১৯৬৭ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন। চার বোন এক ভাই এর মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই গানের প্রতি ছিল তাঁর গভীর আগ্রহ। ছোটবেলায় অন্যান্য ভাইবোনরাও গান শিখেছেন কিন্তু কেউই গানকে জীবনের অঙ্গ করে নেননি যেমনটা নিয়েছিলেন শারমিন পাপিয়া।
প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী তপন মাহমুদ এর কাছে গান শিখেছেন তিনি। তার অন্যান্য গানের গুরুরা হলেন অরূপ রতন চৌধুরী, রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এবং সিডনিতে মঞ্জুর হামিদ কচি। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার গানের স্কুল, সুরের ধারা’র ছাত্রী ছিলেন তিনি। সুরের ধারা’র প্রাক্তন ছাত্র-ছাত্রীদের গড়ে তোলা সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘নন্দন’ এর সাথেও জড়িত ছিলেন শারমিন পাপিয়া।
১৯৯৫ সালে স্বামী হায়দার চৌধুরী বাবু এবং এক বছরের মেয়ে তাসফিয়া কে নিয়ে নিউজিল্যান্ডে অভিবাসী জীবন শুরু করেন। ২০০১ সালে নিউজিল্যান্ড ছেড়ে অস্ট্রেলিয়ায় এসে সিডনির দক্ষিণাঞ্চলীয় সাবার্ব মিন্টোতে থিতু হন তাঁরা।
অস্ট্রেলিয়ায় এসে যুক্ত হয়েছিলেন একুশে একাডেমী অস্ট্রেলিয়ার সাথে। সংগঠনটি দীর্ঘদিন ধরে সিডনির এশফিল্ড পার্কে একুশে বইমেলার আয়োজন করে আসছে। বিশ্বের প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্মৃতিসৌধ এশফিল্ড পার্কে স্থাপিত হয়েছে এই সংগঠনের উদ্যোগেই। তিনি এই সংগঠনের একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
প্রবাসের ব্যস্ত জীবনে সঙ্গীত চর্চা করা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ। তারচেয়েও দুরূহ কাজ নতুন প্রজন্মকে সংগীতচর্চায় উদ্বুদ্ধ করা। শারমিন পাপিয়া এই অসাধ্য সাধন করেছেন। বাংলা গান শিখিয়েছেন তাঁর মেয়েকে। সিডনিতে এসে মা মেয়ে দুজনে মিলেই ভর্তি হয়েছিলেন জনাব মঞ্জুর হামিদ কচি’র গানের স্কুলে। প্রবাসে বেড়ে ওঠা ছেলে-মেয়েদের বাংলা ভাষা শেখানোই যেখানে একটা কঠিন কাজ, সেখানে তাসফিয়ার কন্ঠে যখন বিশুদ্ধ উচ্চারণে বাংলা গান শুনি তখন বুঝতে পারি এর পেছনে বাবা-মায়ের কতখানি সংগীতের প্রতি ভালোবাসা আর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ছিল।
সংগীতচর্চায় স্বামীর পূর্ণ সহযোগিতা পেয়েছিলেন শারমিন পাপিয়া। কথা প্রসঙ্গে তার স্বামী হায়দার চৌধুরী বলেন, “ও গান ভালোবাসতো তাই আমি কখনো বাধা দেইনি বরং উৎসাহ দিয়েছি। অনেকেই সংগীতের সাথে ধর্মের বিরোধ আছে বলে মনে করেন কিন্তু শারমিনের তা ছিল না ও নিয়মিত নামাজ পড়তো আবার ভালোবেসে গানও গাইতো।”
সংগীতের প্রতি শারমিন পাপিয়ার ভালোবাসা কতটা গভীর ছিল তা বোঝা যায় তাঁর জীবনের পরবর্তী সিদ্ধান্ত থেকে। মেয়ে বড় হবার পর ২০১৩ সালে তিনি গান শেখার উদ্দেশ্যে শান্তিনিকেতনে চলে যান দু’বছরের জন্য। সে সময়ে অনেকেই ভেবেছিল তাদের সংসারে ভাঙ্গন ধরেছে; তিনি সম্ভবত আর অস্ট্রেলিয়ায় ফিরবেন না। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র সঙ্গীতের তালিম নেন শ্রীমতি স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় এর কাছে। সেখানে দু বছরের একটি সার্টিফিকেট কোর্স শেষ করে ২০১৫ সালে সিডনিতে ফিরে আসেন শারমিন পাপিয়া। ফিরেই গান ভালবাসেন এমন বেশ কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে তৈরি করেন একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন, আনন্দধারা।
রবীন্দ্র ভক্তদের জন্য শান্তিনিকেতন একটি তীর্থস্থান। সেই তীর্থস্থানে কাটানো সময়ের নানা স্মৃতি নানাভাবে বলার চেষ্টা করেছেন তিনি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। কবি প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে ২০১৬ সালে নিজের বাড়িতে আয়োজন করেছিলেন একটি চমৎকার সংগীত অনুষ্ঠানের। সে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার সুযোগ হয়েছিল আমার। শান্তিনিকেতন সম্পর্কে অনেক অজানা তথ্য জেনেছিলাম সেদিন তাঁর কাছ থেকে। একটা ঘরোয়া অনুষ্ঠান করেই থেমে থাকেননি তিনি ২০১৭ সালে গ্লেনফিল্ড কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজন করেছিলেন রবীন্দ্র জয়ন্তী অনুষ্ঠান। একটি নতুন সংগঠন হলেও তাদের ডাকে প্রচুর জনসমাগম হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে।
শান্তিনিকেতনে প্রতি বছর কবি প্রয়াণ দিবস উপলক্ষে বাইশে শ্রাবণে শোভাযাত্রা সহকারে বৃক্ষরোপণ করা হয়। সিডনিতেও একটুকরো শান্তিনিকেতন তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। ২০১৭ সালে কবি প্রয়াণ দিবসে সিডনির ম্যাককোয়ারি লিংকে জনাব শাহাদাত চৌধুরী’র বাসায় আয়োজন করেছিলেন শোভাযাত্রা সহকারে বৃক্ষরোপণ ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।
সিডনিতে আসার পর প্রতি বছরই তিনি শান্তিনিকেতনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে সেখানে যেতেন। কলকাতার তারা টিভি থেকেও প্রচারিত হয়েছে তাঁর গান।
সিডনিতে তার সংগীতের গুরু মঞ্জুর হামিদ কচি বলেন, “আমি অনেক বছর বাংলাদেশ এবং সিডনিতে গান শিখিয়েছি কিন্তু শারমিন পাপিয়ার মত এমন সংগীত অনুরাগী মানুষ কখনো দেখিনি। গানের জন্য অসাধ্য সাধন করার ক্ষমতা রাখতেন তিনি।”
বাংলাদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গ থেকে বড় বড় শিল্পীদের এনে সিডনির অপেরা হাউসে রবীন্দ্র সংগীতের অনুষ্ঠান করার স্বপ্ন দেখতেন তিনি। অনেকবার অনেকভাবে এই স্বপ্নের কথা বলেছেন বন্ধুবান্ধবের কাছে। কিন্তু জীবন তাঁকে সে সুযোগ দিল না। তবে যারা স্বপ্ন দেখেন তারা স্বপ্ন দেখানও। অন্যরা হয়তো একদিন তাঁর স্বপ্ন পূরণ করবেন।
২০১৮ সালে একমাত্র সন্তান, তাসফিয়া তাবাসসুম এর বিয়ে হয় বাংলাদেশ থেকে পড়তে আসা ছাত্র এবং তাসফিয়ার সহপাঠী আকিব রহমান এর সাথে।
তাঁর অসুস্থতা সম্পর্কে স্বামী হায়দার চৌধুরী বাবু’র সাথে আলাপ করে জেনেছি, ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে তিনি প্রথম ব্যাক-পেইন নিয়ে জিপি’র কাছে যান এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তাঁর ওভারিতে একটা সিস্ট ধরা পড়ে। জানুয়ারির ৬ তারিখে তিনি লিভারপুল হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন অস্ত্রোপচারের জন্য; কিন্তু অস্ত্রোপচার চলাকালীন সময়ে হঠাৎ কিছুক্ষণের জন্য তাঁর হৃদপিণ্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবার কারণে অস্ত্রোপচার অসম্পূর্ণ থাকে। এ অবস্থায় দুই সপ্তাহের মতো লাইফ সাপোর্টে থাকার পর তিনি কিছুটা সুস্থ বোধ করলে তাকে ২২ শে জানুয়ারি আইসিইউ থেকে ওয়ার্ডে স্থানান্তরিত করা হয়। দুই দিন ওয়ার্ডের থাকার পর তাঁর শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি হতে থাকে এবং ২৪ শে জানুয়ারি দুপুরে সেই ওয়ার্ডেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।
২৫ শে জানুয়ারি বেলা ১১ টায় কভিড জনিত সীমাবদ্ধতার মধ্যে স্থানীয় ন্যারাল্যান্ড গোরস্থানে শোকাহত পরিবার-পরিজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের উপস্থিতিতে তাঁর নামাজে-জানাজা অনুষ্ঠিত হয় এবং তাকে সমাহিত করা হয়। আমরা চির নিদ্রায় শায়িত শারমিন পাপিয়ার বিদেহী আত্মার শান্তি কামনা করি।
|