কৃত্রিম সূর্য থেকে বিপুল শক্তির সম্ভাবনা! আনিসুর রহমান
পরমাণু থেকে শক্তি আহরণের ক্ষেত্রে সম্প্রতি একটা বড় ধরনের সাফল্য অর্জিত হয়েছে। গত ৯ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের গণমাধ্যমে বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে খবরটি। যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডশায়ারে অবস্থিত কালহ্যাম গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা এই সাফল্য অর্জন করেছেন। যে প্রক্রিয়ায় সূর্য প্রচণ্ড তাপ এবং আলো তৈরি করে সেই একই ধরনের প্রক্রিয়া ব্যবহার করেছেন বিজ্ঞানীরা। তাই একে অনেকে কৃত্রিম সূর্য বলে উল্লেখ Culham Center for Fusion Energy (CCFE) | করেছেন।
পরমাণু থেকে দুই ভাবে শক্তি আহরণ করা যায়ঃ ফিশন পদ্ধতি এবং ফিউশন পদ্ধতি। দু’টি নামই খুব কাছাকাছি তাই বিষয়টি যাদের কাছে নতুন তাদের জন্য একটু ব্যাখ্যা করতে চাই।
ফিশন পদ্ধতিঃ ফিশন পদ্ধতি হলো বড় বড় পরমাণু কে ভেঙে ছোট করা। অনেকটা ইট ভেঙে খোয়া বানানোর মত। ইউরেনিয়াম একটা বড় পরমাণু। হাইড্রোজেনের পরমাণু সবচেয়ে ছোট। একে যদি আমরা একটা ডিমের সাথে তুলনা করি তাহলে ইউরেনিয়াম এর সাইজ হবে ২৩৫টা ডিম একটার সাথে আরেকটা আঠা দিয়ে লাগিয়ে দিলে যত বড় হবে তার সমান। ইউরেনিয়াম কে ভেঙে ছোট ছোট পরমাণু তৈরি করার প্রক্রিয়াকে ফিশন বলে। এই ভাঙনের ফলে তাপ শক্তি নির্গত হয়। ‘লিটল বয়’ নামে যে পারমানবিক বোমাটি হিরোশিমায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল তার ভেতরে ৬৪ কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম ছিল, তবে ভেঙেছিল মাত্র এক কিলোগ্রাম। এক কিলোগ্রাম ইউরেনিয়ামকে ভেঙে যে তাপ সৃষ্টি হয়েছিল তা হিরোশিমা শহরকে কিভাবে ঝলসে দিয়েছিল সে কাহিনী আমরা সবাই জানি! লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়েছিল এই ফিশন পদ্ধতির বিস্ফোরণ।
নিয়ন্ত্রিতভাবে ফিশন পদ্ধতিকে ব্যবহার করে তৈরি করা হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। পৃথিবীর মোট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের প্রায় ১১ শতাংশ আসে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে। বাংলাদেশের রূপপুরে যে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তৈরি হচ্ছে সেটাও এই পদ্ধতির। এই পদ্ধতিকে ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে তার প্রমাণ রাশিয়ার চেরনোবিল আর জাপানের ফুকুশিমা।
ফিউশন পদ্ধতিঃ ফিউশন পদ্ধতি হলো ফিশন পদ্ধতি ঠিক উল্টো। এই পদ্ধতিতে কয়েকটি ছোট পরমাণুকে জোড়া দিয়ে একটা বড় পরমাণু তৈরি করা হয়। সূর্য এত বিপুল পরিমাণ শক্তি কিভাবে তৈরি করে এ নিয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষ চিন্তা করেছে। আগুন জ্বালিয়ে এত শক্তি তৈরি করা সম্ভব নয়। ১৯০৫ সালে পদার্থ বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তাত্ত্বিকভাবে শক্তির বিশ্ব বিখ্যাত সূত্র, E=mc^2, আবিষ্কার করেন। কত ধানে কত চাল এর মত, কতখানি বস্তু (mass) ধ্বংস করে কি পরিমাণ শক্তি (Energy) পাওয়া যায় এই সূত্র থেকে তা জানা যায়। সূর্যের কেন্দ্রে প্রতি সেকেন্ডে ৬০০ মেগা টন হাইড্রোজেন পরমাণু ফিউশন পদ্ধতিতে জোড়া লেগে ৫৯৬ মেগা টন হিলিয়াম তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ায় হারিয়ে যাওয়া ৪ মেগা টন বস্তু রূপান্তরিত হয় তাপ শক্তিতে। প্রতি সেকেন্ডে ৪ মেগা টন বস্তুকে আইনস্টাইনের সূত্রের মধ্যে ফেললে যে শক্তি পাওয়ার কথা তা সূর্যের মোট উৎপাদিত শক্তির সাথে সুন্দর ভাবে মিলে যায়।
সূর্যের হাইড্রোজেন-হিলিয়াম ফিউশন কে কাজে লাগিয়ে পৃথিবীতে মানুষ তৈরি করেছে হাইড্রোজেন বোমা যা একটি পারমাণবিক বোমার চেয়ে হাজার গুণ বেশি শক্তিশালী তাই একে নিয়ন্ত্রণ করাও অনেক কঠিন। নিয়ন্ত্রিত ফিশন পদ্ধতির প্রথম পারমাণবিক চুল্লি তৈরি হয়েছে ১৯৪২ সালে। কিন্তু বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য কাজে লাগানো যায় এমন ফিউশন চুল্লি এখনো তৈরি করা সম্ভব হয়নি। তবে এ নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গবেষণা চলছে বেশ জোরেশোরে।
ফিউশন চুল্লি Joint European Torus (JET) ফিউশন চুল্লি নিয়ে গবেষণার করার জন্য ইউরোপের দেশগুলি মিলে ১৯৬৫ সালে যুক্তরাজ্যে প্রতিষ্ঠা করেছে কালহ্যাম ফিউশন গবেষণা কেন্দ্র। Joint European Torus (JET) নামে তাদের তৈরি ফিউশন চুল্লিতে অর্জিত হয়েছে সাম্প্রতিক সাফল্য যে বিষয়ে লেখার জন্য এই ভূমিকার অবতারণা।
JET ফিউশন চুল্লিঃ বিজ্ঞানীরা এই চুল্লিতে সম্প্রতি হাইড্রোজেন থেকে হিলিয়াম তৈরি করতে সমর্থ হয়েছেন। এই ফিউশন চালু ছিল মাত্র ৫ সেকেন্ড। একটা আগুন দপ করে জ্বলে উঠে আবার নিভে যাওয়ার মত। তবে এই অল্প সময়েই তৈরি হয়েছে ৫৯ মেগা জুল শক্তি।
কিলোগ্রাম যেমন ভরের একক জুল তেমনি শক্তির একক। প্রাত্যহিক জীবনের কেনাকাটায় কিলোগ্রামের ব্যবহার প্রায় সর্বত্র। তাই এর সাথে আমরা সবাই পরিচিত। কিন্তু শক্তির একক হিসাবে জুল তেমন পরিচিত নয়। খুব সহজভাবে বলতে গেলে ১টা আপেল ১ মিটার উঁচু একটা তাকের উপরে তুলে রাখতে ১ জুল শক্তি লাগে।
জীবন যাপনের জন্য আমরা মোটামুটি চার ভাবে শক্তি কিনে থাকি। খাদ্য, বিদ্যুৎ, গাড়ির জন্য পেট্রোল আর রান্নার জন্য গ্যাস। খাদ্যের শক্তিকে সাধারণত ক্যালোরিতে প্রকাশ করা হয়। বিদ্যুতের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত শক্তির একক হল কিলো-ওয়াট আওয়ার (kWh)। পেট্রোল কেনার সময় আমরা দামের দিকটাই বেশি খেয়াল করি শক্তির কথা ভাবি না। কেবলমাত্র গ্যাসের বিলে জুলের ব্যবহার দেখতে পাই। গত তিন মাসে আমার বাড়িতে রান্না আর গরম পানির জন্য ৫,৮৬৫ মেগা জুল (MJ) শক্তি ব্যবহার হয়েছে। এর সাথে তুলনা করলে বোঝা যায় JET ফিউশন চুল্লিতে উৎপাদিত ৫৯ মেগা জুল খুব বেশি কিছু নয়। তবে যে জিনিসটা খেয়াল রাখতে হবে তা হলো JET চুল্লিটি জ্বলেছিল মাত্র ৫ সেকেন্ড। এটা যদি সারা বছর জ্বালিয়ে রাখা যায় তাহলে ইঞ্জিনিয়ার বন্ধুরা হিসেব করে দেখতে পারেন কি পরিমাণ শক্তি পাওয়া যাবে!
ল্যাবরেটরির বাইরে এনে বিশালাকৃতির JET চুল্লি বা কৃত্রিম সূর্য বাণিজ্যিক ভিত্তিতে তৈরি করলে তা দিয়ে সারা পৃথিবীর শক্তির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব!
এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো এই চুল্লি থেকে কয়লা তেল এবং গ্যাসের মত গ্রিন হাউজ গ্যাস তৈরি হয় না। তাই আজকের গ্লোবাল ওয়ারমিং এর যুগে এর চেয়ে ভাল খবর আর কি হতে পারে!
ফিউশন চুল্লির আরেকটা ইতিবাচক দিক হলো, এতে কোন মারাত্মক তেজস্ক্রিয় পদার্থ তৈরি হয় না তাই চেরনোবিল বা ফুকুশিমার মত ভয়ংকর দুর্ঘটনার সম্ভাবনা এখানে নেই।
আমাদের জন্য নিরাপদ শক্তির উৎস হিসেবে ফিউশন চুল্লি বা কৃত্রিম সূর্যের কোন বিকল্প নেই!
আনিসুর রহমান, সিডনি
|