মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঁচ সপ্তাহ (৬ষ্ঠ পর্ব) সরদার আমীর আজম
আগের অংশ পরের অংশ
কিছু সাধারণ মন্তব্য ও তথ্যাদি
১। প্রথম আমেরিকা-গামী যাত্রীদের ভিসা ও ইমিগ্রেশন/বর্ডার কন্ট্রোল সংক্রান্ত নিম্নোক্ত কয়েকটি বিষয় মনে রাখা দরকার: ক) অস্ট্রেলিয়ান পাসপোর্ট-ধারীদের ৯০ দিন পর্যন্ত আমেরিকা থাকলে ভিসা নেয়ার দরকার নেই (আর ঐ সময়ের মধ্যে কানাডা, মেক্সিকো, বারমুডা কিংবা ক্যারিবিয়ান দ্বীপসমূহে ঘুরে আসা যাবে, যেমন আমরা কানাডা ঘুরে এসেছিলাম); খ) কিন্তু, সেইসাথে ওদের নিয়মানুযায়ী টিকেট কাটার পরে আলাদাভাবে online-এ জনপ্রতি ১৪ আমেরিকান ডলার পে করে ESTA – Electronic System Travel Authorization ভিসা নিয়ে নিতে হবে, যেটি অবশ্য খুব একটা কঠিন কাজ নয় (টিকেট কাটার সময় ট্রাভেল এজেন্ট এটা বলে দিয়েছিল); (গ) আমেরিকা ঢোকার সময় ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস সংক্রান্ত আনুষ্ঠানিকতা ফার্স্ট-এন্ট্রি এয়ারপোর্টে সারতে হবে (যেমনটি আমদের LA-তে করতে হয়েছিল, যদিও চূড়ান্ত গন্তব্য-স্থল ছিল নিউইয়র্ক) এবং লাগেজ নিয়ে টার্মিনালের বাইরে এসে আবার এক্সিট পয়েন্টে ড্রপ করতে হবে পরবর্তী ফ্লাইটে ট্রান্সফারের জন্য; এবং ঘ) আবার ফেরার পথেও ফার্স্ট-এন্ট্রি এয়ারপোর্ট থেকে ইমিগ্রেশন ও সিকিউরিটি চেক-ইন করতে হবে, যেমনটি আমাদের করতে হয়েছিল নিউ জার্সির Newark এয়ারপোর্টে, এবং LA-তে নেমে আমরা শুধুমাত্র হেটে গিয়ে নির্ধারিত গেটে ট্রানজিটে ছিলাম, টার্মিনাল পরিবর্তন করতে হয়নি।
২। একটি মজার ব্যাপার আগে শুনেছি, যা বাস্তবে প্রত্যক্ষ করলাম। যারা অস্ট্রেলিয়া থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পার হয়ে আমেরিকা ইতিপূর্বে গিয়েছে তারা এটি অবগত বৈকি। ব্যাপারটি হল, যাবার পথে ১টি দিন বেচে যায় এবং ফেরার পথে ১টি দিন হারাতে হয়। কারণ হল, সময়ের দীর্ঘ ব্যবধান এবং International Date Line (যা প্যাসিফিকের মাঝখান বরাবর অবস্থিত) অতিক্রম করা। যেমন, আমরা ২১ জুলাই যাত্রা শুরু করেছিলাম সকাল ১০টায়। সময়ের ব্যবধানে সিডনী থেকে ১৭ ঘণ্টা পেছনে থাকার কারণে লস এঞ্জেলসে তখন ছিল ২০ জুলাই সন্ধ্যা ৭টা। International Date Line অতিক্রম করার পরে আমরা আমেরিকার ২০ তারিখের টাইম জোনের মধ্যে পড়েছিলাম। আর দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা ট্রাভেল-টাইম যোগ করে এল এ-তে যখন পৌঁছলাম তখন ওখানে সময় ছিল ২১ জুলাই সকাল ৯টা, অর্থাৎ সিডনী থেকে যাত্রা শুরু করার ১ ঘণ্টা আগেই আমরা পৌঁছে গিয়েছিলাম। অন্যদিকে, ফেরার পথে ২৭ তারিখ রাত ১০টায় আমরা এল এ থেকে যাত্রা করেছিলাম। সময়য়ের ব্যবধানে সিডনীতে তখন ২৮ তারিখ বিকেল ৩টা এবং তাই International Date Line অতিক্রম করার পর আমরা ২৮ তারিখের টাইম জোনের মধ্যে পড়েছিলাম। আর দীর্ঘ ১৪ ঘণ্টা ট্রাভেল-টাইম যোগ করে যখন সিডনী পৌঁছলাম তখন সিডনীর সময় ছিল ২৯ জুলাই সকাল ৬টা। অর্থাৎ ১ দিন পরে আমরা পৌঁছেছিলাম এবং ২৮ তারিখটি আমরা প্যাসিফিকের উপর আকাশে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সুতরাং, আমাদের সাথে সিডনী-গামী কোন যাত্রীর জন্মদিন ২৮ জুলাই হলে, সে তার জন্মদিনটি প্যাসিফিকের উপরে আকাশে হারিয়ে ফেলত। অথবা আমাদের সাথে আমেরিকা-গামী কোন যাত্রীর জন্মদিন ২১ জুন হলে সে অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা দুই জায়গায়ই জন্মদিন পালন করতে পারত।
৩। ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সের ইন্টারন্যাশনাল ফ্লাইটে (নিউইয়র্ক পর্যন্ত) ব্যাগেজ সুবিধা খুবই ভাল ছিল। জনপ্রতি ৫০ পাউন্ড (২৩ কেজি) করে ২ পিস বড় সুটকেস (unaccompanied) এবং সাথে ৭ কেজির একটি কেবিন ব্যাগ ও ১টি ল্যাপটপ অথবা ভ্যানিটি কিংবা ছোট হাতব্যাগ। কিন্তু সমস্যা ছিল আমেরিকাতে ডোমেস্টিক ফ্লাইটে প্রতিবারই ৫০ পাউন্ডের (২৩ কেজি) বড় সুটকেসের প্রতিটির জন্য আমেরিকান ২৫ ডলার করে দিতে হয়েছে। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে সিডনী থেকে আমরা ৩ জন মিলে মাত্র ২টি unaccompanied বড় সুটকেস ক্যারি করেছিলাম সর্বত্র যাতে আমাদের আমেরিকার প্রতিটি ডোমেস্টিক সেক্টরে ৫০ ডলারের বেশি দিতে না হয় (আমাদের মোট ডোমেস্টিক সেক্টর ছিল ৪টি যার টিকেট আলাদাভাবে কাটা হয়েছিল)। আমার মনে হয়েছে, সব এয়ারলাইন্সের আন্তর্জাতিক ফ্লাইটে ব্যাগেজের সুবিধা এই ধরনের একই স্ট্যান্ডার্ডের হলে ভাল হত। তবে বিরামহীন এই দীর্ঘ ও ভ্রমণের তুলনায় কিঞ্চিত হলেও লাগেজ নিয়ে কিছুটা বিড়ম্বনার শিকার হতে হয়েছিল নিউ জার্সির নিউইয়র্ক এয়ারপোর্টে। ২১ জুন নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে পৌঁছে দেখলাম আমদের সাথে ফ্লাইটে একটি বড় সুটকেস আসেনি। ট্যাগ নম্বর নিয়ে কাষ্টমার সার্ভিস ডেস্কে রিপোর্ট করায় কম্পিউটার চেক করে বলল ১ ঘণ্টা পরে পরবর্তী ফ্লাইটে আসছে। সুতরাং, বন্ধুর বাসা অনেক দূরে বিধায় ১ ঘণ্টা অপেক্ষা করে পরবর্তী ফ্লাইটে আসা সুটকেস সংগ্রহ করতে হয়েছিল (উল্লেখ্য, LA থেকে Newark প্রতি ঘনটায় ফ্লাইট আসা-যাওয়া করে)। আবার ২৫ জুন মেয়ে ঈশানের বেলায় হয়েছিল উল্টোটি, যা একটু অবাক করেছিল বৈকি। LA থেকে নিউইয়র্ক-গামী ওর ফ্লাইটটি ছাড়তে ঘণ্টা-খানেক বিলম্ব হওয়ায়, ওর unaccompanied সুটকেসটি ওদের আগে ছেড়ে আসা ফ্লাইটিতে চলে এসেছিল। তাই নির্ধারিত conveyer belt-এ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকেও সুটকেস না পেয়ে এবারও শরণাপন্ন হলাম কাষ্টমার সার্ভিসের। কম্পিউটার চেক করে বলল আগের ফ্লাইটে চলে এসেছে এবং পাশের একটি রুম দেখিয়ে দিল, যেখানে সেটি রক্ষিত ছিল। সাধারনতঃ ফ্লাইট বিলম্বের কারণে দেরিতে লাগেজ পৌঁছা সংক্রান্ত বিড়ম্বনার শিকার হয়েছি কিংবা শুনেছি। কিন্তু লাগেজ আগে পৌঁছার ঘটনা ঘটল এই প্রথম। যাইহোক, ব্যস্ত আমেরিকার অতি ব্যস্ত শত শত এই এয়ারপোর্টগুলিতে (যেগুলি দিয়ে দৈনিক হাজার হাজার ফ্লাইটে মিলিয়নের অংকে যাত্রীরা ভ্রমণ করছে বলতে হবে) লাগেজ সংক্রান্ত এই ধরনের বিড়ম্বনা ঘটার সম্ভাবনার বিষয়টি গোচরে রাখা ভাল।
৪। এইসাথে বর্তমানকালের যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির বিশাল উন্নয়ন সম্পর্কিত একটি ব্যাপারও উল্লেখ্য। মেয়ে ঈশান দীর্ঘ সময়ের বিমান ভ্রমণে সর্বদাই motion sickness-এ আক্রান্ত হয়। আগেই বলেছি, পরীক্ষা-জনিত কারণে সে ২৫ জুন একা ভ্রমণ করেছিল। তাই বিশেষ করে Sydney-LA এ সেক্টরের দীর্ঘ ১৫ ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে হেটে টার্মিনাল পরিবর্তন করে আবার LA-Newark সেক্টরের ৫ ঘণ্টার ফ্লাইট শেষে একাকী নির্বিঘ্নে পৌঁছা নিয়ে আমরা বেশ শঙ্কিত ছিলাম। বলেছিলাম লস এঞ্জেলসে পৌঁছে আমাদেরকে একটি SMS কিংবা টেলিফোন করে জানিয়ে দেবার জন্য, যখন নিউইয়র্কে ছিল সকাল। কিন্তু ওদের ফ্লাইট LA-তে পৌঁছার নির্ধারিত সময়ের অনেক পরেও যখন কোন টেলিফোন কিংবা বার্তা পেলামনা তখন বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লাম সুস্থভাবে LA-তে পৌঁছতে পারল কিনা? তাই google সার্চ করে LA এয়ারপোর্টের নম্বর যোগাড় করে টেলিফোন করলাম ঠিক সময়ে ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে কিনা এবং মেয়ে ঈশান ঠিকমত পৌঁছেছে কিনা। অন্য প্রান্ত থেকে জানানো হল, আমাদের মেয়ে ঠিকমত পৌঁছে ওর নির্ধারিত টার্মিনালে গিয়ে চেক-ইন করে কানেকটিং ফ্লাইটের জন্য অপেক্ষা করছে। খুবই আশ্বস্ত হলাম সঠিক তথ্যটি পেয়ে। একটু পরে মেয়েও SMS করে জানাল একই কথা। কিন্তু অবাক হয়েছিলাম এই জেনে যে, টেলিফোনে তথ্যটি দেয়া হয়েছিল প্রশান্ত মহাসাগরের অপর পারের সুদূর ফিলিপাইনের ম্যানিলার একটি call centre থেকে। অস্ট্রেলিয়াতেও সাম্প্রতিককালে আমরা দেখছি প্রশাসনিক ওভারহেড খরচের সাশ্রয়ের জন্য অনেক কোম্পানি তাদের কাষ্টমার ও অন্যান্য সার্ভিস তৃতীয় বিশ্বের ইন্ডিয়া, ফিলিপাইন, এমনকি আমাদের বাংলাদেশও, ইত্যাদি দেশগুলিতে অবস্থিত কল সেন্টারগুলির মাধ্যমে দিচ্ছে। বর্তমান globalization ও digital যুগে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির এই বিস্ময়কর উন্নয়ন বলেই কিনা কথা!
৫। আমেরিকাতে ওজনের মান পাউন্ড বিধায় জিনিষপত্রের দাম নিয়ে প্রায়শই বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে। হঠাৎ করে সস্তাই মনে হত। কিন্তু যখন দেখতাম পাউন্ড প্রতি (অর্থাৎ কেজি প্রতি দ্বিগুণ) এবং অস্ট্রেলিয়ান ডলারে আরো প্রায় ৪০% বেশি, তখন মোহভঙ্গ হত। উপরন্তু, আমেরিকাতে সর্বত্র ট্যাক্স দামের বাইরে ধরা হয় (অস্ট্রেলিয়ার মত GST inclusive নয়) তখন কষ্টদায়ক মনে হত। কিন্তু তেলের দাম সস্তা – গ্যালন (৪.৫ লিটার) প্রতি ২ থেকে ২.৫০ ডলার (অর্থাৎ অস্ট্রেলিয়ান ডলারে ৩ থেকে ৩.৫ ডলার, অর্থাৎ লিটার-প্রতি আমাদের ৭০ সেন্টের মত, যেহেতু আমেরিকা অন্যতম তেল উৎপাদনকারী দেশ। অন্যদিকে, দূরত্বের পরিমাপ মাইলে (অর্থাৎ ১.৬২ কিঃমিঃ) বিধায় ড্রাইভ করার সময় স্পীড নিয়ে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়তে হয়েছে (যেমন, স্পীডলিমিট ৭০ মাইল হলে আমাদের ১১৫ কিঃমিঃ)। অন্যদিকে দেখেছি, রেস্টুরেন্টগুলিতে (যেখানে সার্ভ করে খাওয়ানো হয়) বিলের সাথে মোট দামের ১৫% সার্ভিস চার্জ কিংবা টিপস (বখশিশ) হিসেবে যোগ করা হয় যেটি ওখানে নিয়ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
৬। অস্ট্রেলিয়াতে আমরা যেখানে ৫ সেন্টের মুদ্রা নিয়ে অনেকটা বিরক্ত বোধ করি, সেখানে আমেরিকার বাজারে এখনো পর্যন্ত ১ সেন্ট চালু আছে দেখে বেশ অবাক হয়েছি। ১ সেন্টের কয়েন নিয়ে সেছিল যেন এক বিব্রতকর অবস্থা। তাও আবার সিলভার নয়, তাম্র মুদ্রা (শুধু ১ সেন্ট)। ১০ সেন্টকে বলে ডাইম (কিন্তু ৫ সেন্টের কয়েনের চেয়ে আকারে ছোট)। জিনিষ-পত্রের দাম দিতে গিয়ে অনেকটা অবাক হয়েই লক্ষ্য করেছি প্রাপ্য খুচরা কয়েন ফেরত দিতে গিয়ে দোকানীরা অন্যান্য কয়েনের মাঝে ১ থেকে ৪ সেন্ট প্রাপ্য হলে অনায়াসেই ১ সেন্টের কয়েন গুনে গুনে ফেরত দিয়েছে। এইভাবে প্রচুর পরিমাণে ১ সেন্ট যখন জমেছে তখন অনেকটা বিভ্রাটের মধ্যেই পড়তে হয়েছিল বইকি। তবে পরবর্তীতে কেনা-কাটার সময়ে ব্যবহারও করে ফেলেছি। পৃথিবীর বৃহত্তম অর্থনীতি, তবুও ১ সেন্টকে হিসেবের মধ্যে নেয়া হচ্ছে এখনো। আমার কাছে মনে হয়েছে, এই ধরনের পাই-টু-পাই হিসেবি হবার কারণেই হয়তো অর্থনৈতিক দিক থেকে আমেরিকার শীর্ষে পৌছার অন্যতম কারণ হবে হয়তো (চলবে)
আগের অংশ পরের অংশ
|