bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












সুন্দর ফন্টের জন্য SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন...

ছোট গল্প

নগ্ন নির্জন হাত
মুনশি আলিম





বিকেল বেলা। ব্যাগ ভর্তি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও কাপড়-চোপড় নিয়ে জৈন্তা বাস স্ট্যান্ডে আসলাম। তখনও বিরতিহীন না আসায় আমি স্ট্যান্ডের উল্টোদিকে যাই। উদ্দেশ্য মোবাইলের সিমে টাকা লোড করা। জাফলং থেকে প্রায় বিশ মিনিট অন্তর অন্তর বিরতিহীন আসে। অবশ্য এখনকার বিরতিহীন গাড়িগুলো আলসেমির কারণেই হোক আর চতুরতার কারণেই হোক ‘বিরতিহীন’ শব্দটি আর ব্যবহার করে না। প্রায় মিনিট পাঁচেক পর এক বাস এলো। স্ট্যান্ডে আসতে না আসতেই গাড়ির চাকায় সমস্যা দেখা দিল। নতুন টায়ার না লাগালে কোন ক্রমেই আর গাড়ি চালানো সম্ভব হবে না। বাধ্য হয়ে ড্রাইভার ও হ্যান্ডিম্যান নতুন চাকা লাগানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে গেল। যাত্রীরা অনেকেই নেমে গেল। চাকা পাংচার হওয়ায় যাত্রীদের মধ্যে কেউ কেউ ড্রাইভারকে দোষারোপ করতে লাগলো আবার কেউ কেউ নিজের ভাগ্যকে।

গাড়ির ডানদিকে দ্বিতীয় সিটে বসা এক সুন্দরী তরুণী। অপূর্ব সুন্দর দু'টি চোখ। স্বর্গের আবির মাখা ঠোঁট। গালের ডানদিকে ছোট একটি তিল তার সৌন্দর্যকে যেন বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভাবুকের মত এলোচুল। দৃষ্টি তার দূর দিগন্তে। বহির্বিশ্বের কোলাহল তাকে যেন সহসাই স্পর্শ করার সাহস পায় না। নিজের ভেতরেই নিজের একটু নির্জনতা। আর সে নির্জনতার গহীনে স্বপ্ন ডাঙার মৃদু উল্লাস, সমস্ত অনুভূতি জুড়ে সহস্র বছরের সঞ্চিত নিবেদনের পরিসমাপ্তি, নয়াগ্রা জলপ্রপাতের সমস্ত সৌন্দর্য আজ যেন তার হৃদয় ক্যানভাসে। আমার দিকে চোখ পড়তেই সে একটু মৃদু হাসলো। কী অপূর্ব সে হাসি! তার হাসির ধারে কাছেও নেই জগৎ বিখ্যাত বিষ্ময়ী মোনালিসা। সূর্যের ঈষৎ আভায় তার সুশ্রী মুখ জুড়ে খেলা করে রোদ্রোজ্বল। তার অস্তিত্বের ভাঁজে ভাঁজে খেলা করে শতাব্দীর নিংড়ানো সুন্দর। মনের কোথায় যেন গোপন লিপ্সা দানা বাধতে থাকে। নিজের ভিতরে সমুদ্র জোয়ারের মত তৃষ্ণার ঢেউ উপচে উঠতে থাকে। নিজের ভিতরে নিজে মুষড়ে পড়তে থাকি। আমার ভেতরে যেন আর কোন আমিত্ববোধ নেই। কয়েকশ শতাব্দী ধরে যেন আমি তাকেই খুঁজছি। এক পলকেই আমার মনে হল এ যেন আমার সহস্র বছরের পরিচিতা! এ যেন আমার সর্গচ্যুত কোন দেবী! ভাগ্যের পালাবদলে যেন তাকে আমি খুঁজে পেয়েছি। আমি আমার লজ্জার আড়ষ্টতা ভেঙে আবারও তার দিকে তাকাই। সেও তাকায়। চার চেখের মিলন হল।

চোখে চোখে অনেক কথা হয়ে গেল। চোখের ভাষা শুধু চোখ দিয়েই বুঝতে হয়। পৃথিবীর সকল ভাষার পুস্তকি ব্যাখ্যা-তর্যমা থাকলেও এখনো চোখের ভাষার কোন ব্যাখ্যা কিংবা তর্যমা আবিষ্কৃত হয় নি! আমি মোবাইলে লোড দেয়ার কথা প্রায় ভুলেই গেলাম। হঠাৎ ঠিক পিছন থেকে লোডের দোকানদার বলে উঠল- ভাইসাব, লোড লাগবো নি?

প্রথমটায় আমি একটু ভ্যাবাচেকা খেলেও নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম- জি অয়।

- নাম্বারটা কউক্কা...
- ০১৭... আমি নাম্বার বলি।

- খতো দিতাম?

- ১০০ দেউক্কা

- জি আইচ্চা

দোকানদারকে টাকা দিয়ে আমি পুনঃ মেয়েটির দিকে তাকাই। গাড়ি চাকা তখন প্রায় লাগানোর শেষ পর্যায়ে। অন্যান্য যাত্রীরাও তখন গাড়িতে উঠছে। এমন সময় এক মহিলা ভিক্ষুক এসে আমাকে বলল- আল্লারাস্তে থুরা ভিক দেউকক্কা। আমি তার দিকে না তাকিয়েই বললাম- মাফ খর গো মাই। অন্যবায় যাও।

মহিলা নাছোড় বান্দা। সে যেন ভিক্ষা না নিয়ে যাবেই না। একরকম অধিকার খাটিয়েই সে পুনঃ বলল- আফনারা না দিলে খানো যাইতাম? খিতা খাইতাম, চিকিৎসা অইতাম কিলা? চিকিৎসার কথা শোনামাত্রই আমি তার দিকে তাকালাম। ওমা একে তো চেনা চেনা লাগছে। - আফনে মিলি আফা না? কৈন্যাখাইয়ের মুতলিব চাচার পুড়ি নাই নি?

সে তখন আচল দিয়ে পুরো মুখ ঢাকার নিছক চেষ্টা করে। আগেই মুখের বেশ কিছু অংশ ঢাকা ছিল। আমি নাম উল্লেখ করতেই যেন সে লজ্জায় এখন পড়িমরি করে পালানোর মত অবস্থা! আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম- আফা, ওবাউক্কা। ... খিতা অইছে আফনার? আফনার অউ হালত খিলা অইলো? আফনে রাস্তাত খেনে? আমি একাধারে অনেক প্রশ্ন করে ফেললাম।





মুতলিব চা ঐ এলাকার এক অখ্যাত মুক্তিযোদ্ধা। সাত মেয়ের এক বড় পরিবার তার। এখন নিজের ভূমি বলতে তেমন কিছুই নেই। মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের কারণে তাকে অনেক কিছুই হারাতে হয়। তার স্ত্রী ও চার কন্যাকে ধর্ষণের নারকীয় উৎসবের পর নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। ছোট তিন মেয়ে সেদিন ভাগ্যক্রমে খালার বাড়ি থাকায় প্রাণে বেঁচে যায়। এরপর থেকে তারা আর তাদের নিজের বাড়িতে আসতে পারে নি। এমনকি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও তারা আর তাদের পৈত্রিক ভিটা উদ্ধার করতে পারে নি। স্থানীয় রাজাকারের সংঘবদ্ধ-চক্র ভাগ বাটোয়ারা করে নিয়েছে। এখানেই শুধু শেষ নয়। চোর অপবাদ দিয়ে পরবর্তীতে তাদের গ্রাম ছাড়া করেই তারা ক্ষান্ত হয়েছে। অবশ্য তখনও মেয়েগুলো বেড়ে ওঠে নি। এজন্যই হয়ত কিছুটা রক্ষে! এই ঘটনার পর অনেক বছর অতিবাহিত হয়েছে। ওদের আর তেমন খোঁজ খবর নেওয়া হয়ে ওঠ নি। এরই মধ্যে আমি অনার্স, মাস্টার্স সম্পন্ন করলাম। এমফিল কোর্সও প্রায় শেষের পথে।

বেসরকারি কলেজে প্রভাষক পদে চাকরি করছি এবং পাশাপাশি সাংবাদিকতাও। সংবাদ অন্বেষণের জন্য প্রতিনিয়তই বহু জাতের লোকের সাথে মিশতে হয়। সাংবাদিকতা পেশাতে যেমন সম্মান আছে তেমনি আছে ঝুঁকি। তবে আমি মনে করি সাংবাদিকতা হল প্রতিনিয়ত সাধারণকে জানার একটি মহৎ পেশা। আমি গভীর আগ্রহ নিয়ে মিলি আপুকে জিজ্ঞেস করলাম- আমারে এখটুতা খুলিয়া খইবা নি? মূল ঘটনা জানার খুব ইচ্ছা আছিল, আফনার মুখ জ্বলছে কিলান? একসিডেন্ট খরিয়া না অন্যকোন...?

আমার কথাটি শেষ না হতেই সে ঢুকরে কেঁদে ওঠে। আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি। বাজারের মধ্যে কোন মেয়ে মানুষের কান্না কখনোই শোভন দৃষ্টিতে দেখা হয় না। মিলি আপুর মুখের একাংশ দেখে আমার মনে হয়েছে- হয়ত মাস তিনেক আগে তার সুশ্রী মুখে কোন নরপশু এসিড ছুড়ে মেরেছে। যার ক্ষত এখনো সে বয়ে বেড়াচ্ছে।

বাম হাতে আচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে ঈষৎ অনুচ্চ স্বরে মিলি বলল- "আমিও চাইছলাম আফনারার লাখান বাঁচতাম; স্কুল, কলেজ, ভার্সিটিত পড়তাম। কিন্তুক কিছু সংখ্যক মানুষরূপী জানুয়ারের লাগি আমার সুন্দর জীবনটা নষ্ট অই গেছে। আজিজ মণ্ডলের বড় পুয়া আইনুলের কুপ্রস্তাব মানছি না খরি একদিন মাইঝরাত্রে আইয়্যা আমার মুকর মাজে... এসিড মারি দিছে। আমি মুরব্বিনতেরে খইলাম কিন্তুক তাইন আমর মাত বিশ্বাস খরছইন না। পুলিশেও তার নামে মামলা নিছইন না। তারা খইন, কোন প্রমাণ ছাড়া আমরা তারে ধরতাম ফারি না! গরিব কোন দিনও ন্যায্য বিচার ফায় না ভাই!"

কথাটি বলেই সে পুনরায় অশ্রু মুছতে লাগলো। আমার কেন যেন তখন পুলিশের উপর খুব রাগ হতে লাগলো। সবচেয়ে বেশি রাগ হতে লাগলো সেই নরপশু আইনুলের ওপর। মনে মনে পণ করলাম, এ বিষয়ে আজই পত্রিকায় নিউজ করব। নিউজ করলে তো ছবি লাগবে। এসিড দগ্ধ মেয়ের ছবি দিলেই তা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব বহন করে। আর পত্রিকায় একবার লিড নিউজ হলে প্রশাসনেরও তখন বেশ টনক নড়ে। আমি ব্যাগ থেকে ক্যামেরা বের করতেই স্ট্যান্ডে গাড়ি ছাড়ার ভ্যাঁপু শুনতে পেলাম। মনের ভেতরটায় মুহূর্তেই মোচড় দিয়ে ওঠে। আমি পুনরায় বাসের মেয়েটির দিকে তাকাই। মেয়েটি মুচকি হাসে। তার হাসির নিংড়ানো পরাগ-রেণু যেন সুপিরিয়র লেকের সুপেয় জলের মত! সূর্যের দীপ্তি ছড়ানোর মত যেন তার হাসির পবিত্র আভাও চারদিকে অবলীলায় ছড়িয়ে পড়ছে। সে হাসি স্রষ্টা যাকে দিয়েছে তার আর অন্য কিছু করার প্রয়োজন নেই।

মিলি আপুর কথা ভেবেই আমার আর গাড়িতে যাওয়া হয়ে উঠলো না। নিজেকে প্রবোধ দিতে থাকি। কিন্তু মন যেন কিছুতেই মানছে না। সকল ক্ষেত্রই মন আপোষ করতে চায় না। জীবন পরিক্রমার কোন কোন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন হয়ে ওঠে চূড়ান্ত পর্যায়ের আপোষহীন। আমি গাড়িতে ওঠার জন্য পা বাড়াতেই মিলি আপু বলল- "আমি জানতাম আফনেও যাইবা গি, আফনার লাখান অনেখ মানুষই মুকে মুকে খুব বড় বড় মাতে কিন্তু কামর বেলায় তাইন তাইনরে আর মিলে না!"

আমার পা আর নড়তে চায় না। আমার চোখ তখন গাড়িতে বসা সেই মেয়েটির দিকে। সমীচীন নয় তবুও ভাললাগার তীব্রতা প্রকাশে হাত দিয়ে টাটা দেই। মেয়েটি খুশি হয়। খুশিতে যেন সে গড়িয়েই পড়বে! একরকমের সৌজন্যবোধ থেকেই বোধহয় সেও আমার বিদায়ী টাটার উত্তর দিতে গাড়ির জানালা দিয়ে হাত বের করল। টাটা দিতে থাকল। গাড়ি তখন চলতে শুরু করছে। উল্টোদিক থেকে একটা ট্রাক খুব দ্রুত আসছিল। মুহূর্তের জন্য তাকে আমার থেকে আড়াল করে দিল। আর তখনই শুনতে পেলাম গগণবিদারী তীব্র চিৎকার।

আশে পাশে লোকজন দ্রুত জমতে থাকে। আমিও খোলা ক্যামেরা নিয়ে এগিয়ে যাই। আমার পিছনে মিলি আপু এসেছিল কিনা খেয়াল করি নি। মুহূর্তেই সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমি ভিড় ঠেলে সামনে যেতই দেখি – রক্তাক্ত ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় রাস্তার মধ্যে পড়ে আছে একটি ‘কাটা নগ্ন নির্জন হাত’। এ যে আমাকে বিদায় দেওয়া সদ্য বিদায়ী হাত! চিনতে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট হয় নি।

আকাশে তখন মেঘ জমেছিল কিনা তা আর খেয়াল করা হয়ে ওঠে নি, কিন্তু আমার মনের ঘরে মুহূর্তেই পৃথিবীর সব তমসা এসে বাসা বাঁধল। আমার শরীর ছায়া মূর্তির মত স্থবির হয়ে ওঠল। জিভ আড়ষ্ট হয়ে ওঠল। ক্ষমাহীন অপরাধ মনের মধ্যে ঘুরপাক করতে লাগলো। বারবারই মনে হতে লাগলো- আমাকে বিদায় দিতে গিয়েই তো... ! নিজের ভিতরে ক্ষরণ, দহন শুরু হল। কী যে সে দুঃসহ ক্ষরণ! দুঃসহ দহন! বহির্বিশ্বের দহন চক্ষু-গ্রাহ্য হলেও মনের বিশ্বের দহন সব সময়ই থাকে লোকচক্ষুর অগোচরে। আমার ডান হাতের খোলা ক্যামেরাটি কোন এক অজ্ঞাত কারণে কাঁপতে কাঁপতে রাস্তায় পড়ে গেল। আমার দু'চোখ জলে ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে। কম্পিত হাতেই পকেট থেকে টিস্যু বের করি। চোখে কিছু একটা পড়েছে এবং তা বের করার মিথ্যে অজুহাতে চোখ মুছতে থাকি। বেদনার তীব্রতায় মনে অজান্তেই মুখ থেকে বেরিয়ে গেল- উহ্! তপ্ত আকাশে চিলের ক্ষীণ ডাক মুহূর্তেই ম্লান হয়ে যায় মহাকাশের গভীর থেকে গভীরে।


মুনশি আলিম, সিলেট
munshialim1@gmail.com






Share on Facebook               Home Page             Published on: 12-Oct-2014

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far