ভাষার বিড়ম্বনা! কামরুল মান্নান আকাশ
To know, is to know that you know nothing. That is the meaning of true knowledge - Socrates
পত্রিকায় একটি সংবাদের হেডিং দেখলাম “লেডিস টয়লেটে ঢুকে পড়লেন রাহুল গান্ধী”। এটা ঘটেছিল গুজরাটে, রাহুল গান্ধী গুজরাটি ভাষা পড়তে না পারার কারণে। এরকম ঘটনা আমাদের অনেকের জীবনেই অনেক সময় ঘটেছে ভিনদেশে গিয়ে, সে দেশের ভাষা না জানার কারণে।
১৯৯০-৯১ সাল; আমি গিয়েছি নেদারল্যান্ডের এনেস্কেডে শহরে পড়তে। ডাচ ওদের মূল ভাষা হলেও সবাই ভাল ইংরেজি বলে। তারপরও একদিন যাচ্ছি University of Groningen, রাস্তায় এক বুড়ো বুড়িকে জিজ্ঞেস করলাম University টা কোথায়, বলতে পারলামনা। ওরাই তখন আরেক তরুণকে ডেকে দিল, সে আমাদের দেখিয়ে দিল। আর দুইজনই সমস্বরে বলে উঠল ও Universiteit! এই রকম সামান্য উচ্চারণ বা বাচনের তারতম্যের কারণে ভাষা দুর্বোধ্য হয়ে উঠে।
The University of Twente এর এনেস্কেডের Geo-Information Science and Earth Observation (ITC) Faculty তে আমাদের ক্লাস হত এবং যেখানে আমরা থাকতাম সেই ডিস হোটেল ছিল জার্মান বর্ডারের খুব কাছেই। এটি ছিল একটি ফাইভ স্টার হোটেল যার ১০ তলা পর্যন্ত ছিল ছাত্রদের জন্যে আর উপরের তলা গুলো ছিল অতিথিদের জন্য বরাদ্দ। জার্মানিতে খাবার দাবার ও ফোন কল সস্তা ছিল বলে আমরা প্রায়ই সেখানে চলে যেতাম সাইকেল চালিয়ে কিংবা হেঁটে।
জার্মানির গ্রামীণ যে ছোট্ট শহরটিতে আমরা যেতাম তাঁর নাম ছিল মুন স্টার। সেখানকার রাস্তা ঘাট, দোকান পাট থেকে শুরু করে খাবার-দাবারের নামসহ বেশীর ভাগই লেখা থাকত জার্মান ভাষায়। কিছুই বুঝিনা, কাউকে জিজ্ঞেস করলেও কিছু বলে না। ভাবলাম ওরা বোধ হয় ইংরেজি জানেনা। আমাদের দেশের দোকানদাররা এদের তুলনায় কিছু হলেও ইংরাজি শব্দ জানে। কিন্তু একদিন যখন এক দোকানি স্পষ্ট ইংরেজিতে বলল “Can you speak in German” আমরা অপারগতা প্রকাশ করার পর সে আর একটি কথাও বলল না। তখন বুঝলাম এরা খুব উন্নাসিক এবং জার্মান জাতীয়তাবাদের বাইরে কিছু বুঝতে চায় না। মনে পড়ল নুরুল আমিন স্যারের কথা যিনি আমাদের সাবসিডিয়ারিতে ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি পড়াতেন। উনি বাংলা ভাষায় আমাদের ক্লাস নিতেন। শুরুতে বলেছিলেন কেন তিনি বাংলায় রসায়ন পড়াচ্ছেন। স্যার যখন জার্মানিতে পড়তে যান আগে তাদের ভাষা শিখতে হয়েছে তারপর পি এইচ ডি কোর্স শুরু করতে পেরেছেন। তখন প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেশে ফিরে নিজের ভাষায় পড়াবেন।
বাসে করে যাচ্ছি ভেঙ্গে ফেলা বার্লিন ওয়াল দেখতে। গন্তব্যের কাছাকাছি গিয়ে বাস থামলো। আমি একটু রেস্ট রুমের দিকে এগিয়ে গেলাম। যেয়েই পড়লাম মুশকিলে। দেখি দুটি দরজা একটিতে লেখা Herren আরেকটিতে Frauen এবং কোন ছবি নেই। কোনটা ছেলেদের আর কোনটা মেয়েদের বোঝার উপায় নেই। ঢুকে পড়লাম Frauen লেখা দরজা ঠেলে। ঢুকেই বুঝতে পারলাম ভুল জায়গায় ঢুকে পড়েছি। যখন বেরিয়ে আসছি দরজায় এক জার্মান ললনার সাথে দেখা সে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইল! পরে ভেবে দেখেছি যদি সময় নিয়ে ভাবতে পারতাম তাহলে হয়ত F দিয়ে যে রুমের নাম শুরু সেখানে না ঢোকাটাই ছিল যুক্তিযুক্ত, কারণ F for Female.
নেদারল্যান্ডকে বলা যায় সাইকেলের দেশ, যেখানে সাইকেলের জন্য আলাদা রাস্তা আছে। আমরাও ঘুরে বেড়াই। আর জার্মানি যাওয়াটা হয়ে গেল ডাল ভাত। আমাদের ছাত্র উপদেষ্টা বলে দিয়েছিলেন ওখানে যেতে পাসপোর্ট, ভিসা দরকার নেই, আমাদের আই ডি কার্ডই যথেষ্ট। বর্ডার সব সময় খোলাই থাকে কখনো চেক টেক করে না। আর আমরা একটুও না থেমে সাইকেল চালিয়ে সোজা ঢুকে যাই জার্মানিতে। সেদিনও একই ভাবে ঢুকে গেলাম বর্ডার পেরিয়ে ফুল স্পিডে। সাথে ছিল ফিলিপাইনের লাসারনা, নেপালের বজরাচারিয়া, কলাম্বিয়ার ভিনসেন্ট, গাম্বিয়ার মসি। মাঝখানে মনে হল একটা চিৎকার শুনেছিলাম। কিন্তু আমরা তখন যৌবনের উচ্ছ্বাসে এমন এক সাইকেল রেস লাগিয়েছি যে কোনদিকেই খেয়াল নেই। টার্গেট একটাই প্রথম হতে হবে। হুইসেলের আওয়াজ শুনে সবার হুঁশ ফিরল। পিছনে তাকিয়ে দেখি জনা চারেক সৈনিক অস্ত্র হাতে ছুটে আসছে আমাদেরই দিকে আর থামতে ঈশারা করছে। ওদের দেখে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের উপর দেখা সিনেমার দৃশ্য এবং হিটলারের মুখটা মনে পড়ে গেল। জান প্রাণ দিয়ে এমন কড়া ব্রেক করলাম যে সাইকেল নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম। ওরা এসে ঘিরে ধরল আমাদের। বন্দুক নেড়ে ঈশারা করল ওদের ক্যাম্পের দিকে যেতে। একজন পাতি অফিসার কর্কশ স্বরে জানতে চাইল থামতে বলা স্বত্বেও কেন থামিনি আমারা। বলতে চেয়েছিলাম তোমাদের ভাষা বুঝি না কিন্তু বললাম যে আমরা শুনতে পাইনি। তাছাড়া আগে কখনো কেউ আমাদের এখানে থামায়নি তাই বুঝতে পারিনি। বলল জেল থেকে কিছু বন্দি পালিয়েছে তাই এই কড়াকড়ি। সাবধান করে ছেড়ে দিল। বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও স্পেনের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জিওলজিকেল ফিল্ড ওয়ার্ক করতে যেয়েও ভাষার কারণে অনেক ধরনের অভিজ্ঞতা হয়েছে।
১৯৯৪ সালের কথা, AGID (Association of Geoscientists for International Development) এর কনফারেন্সে কলম্বো যাচ্ছি আমি, কচি, টিপু ও খায়রুল ভাই। কলম্বো এয়ারপোর্টে পৌঁছে ডিউটি ফ্রি শপে ঘোরা ঘুরি করছি। সারা এয়ারপোর্টে কড়া আর্মির পাহারা। একেতো তামিল টাইগারদের উৎপাত সাথে আবার তখন পোপ আসছেন শ্রীলংকা সফরে। হঠাৎ খুব উচ্চ স্বরে কেউ বলে উঠল নাভতান্না বা এই ধরণের কিছু একটা। পিছনে তাকিয়ে দেখি আর্মির একটা দল আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। আমরা যেই হাঁটা ধরলাম অমনি ওরা এগিয়ে এসে ঘিরে ধরল। বলল তোমাদের থামতে বলছি থামছনা কেন। বললাম তোমার কথাই তো আমরা বুঝিনি কি বলছ। তখন জানলাম সিংহলী ভাষায় navatvanna মানে হচ্ছে থাম।
ওদেরকে বললাম সেই মাদ্রাজ এয়ারপোর্ট থেকে তোমরা আমাদের পিছনে লেগেছ ব্যাপারটা কি বলবে। মাদ্রাজ এয়ারপোর্টে যখন ইমিগ্রেশন পার হচ্ছি তখন থেকেই শ্রীলংকান সৈন্য দেখে অবাক হয়েছি। ওরা ওখানে একবার চেক করল, আমাদের carrier Air Lanka সেখানে উঠার পর আরেকবার চেক করল। সিটে বসে আছি তাও দেখি একটু পর পর এসে আমাদের দেখছে, কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে। প্লেন টেক অফ করার পূর্ব মুহূর্তে একজন অফিসার এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গেল কেবিন ক্রুদের রুমে। তোমাকে আবার চেক করব বলে আমার সারা শরীর তন্ন তন্ন করে সার্চ করল। আমি একটু মন খারাপ করে ফিরে এলাম। খায়রুল ভাই মজা করে বললেন কি আকাশ আমরাতো ভাবলাম আপনাকে আর ছাড়বেই না। আর তখনি আরেক সৈন্য এসে একটা গোল মতন কেবিন ব্যাগ বের করে বলল এটা কার। খায়রুল ভাইয়ের মুখটা সাথে সাথে শুকিয়ে গেল বলল আমার। ওরা আবার ওটা ভাল করে চেক করল। আমরা খায়রুল ভাইকে খেপাতে লাগলাম। আসলে বোমের মত সেপের ব্যাগে কি আছে তাই ওরা দেখতে এসেছিল কিন্তু আমার প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার কারণ তখন বুঝতে পারিনি।
ফিরে আসি বর্তমানে। ওরা বলল তুমি কি জান তুমি কার মত দেখতে! বললাম না। ওদের দল নেতা জানাল আমি নাকি দেখতে তামিল টাইগারদের নেতা প্রভাকরণের মতন তাই এই সন্দেহ। মনে মেনে বললাম ওই বেটা কি তোমাদের সামনে এসে স্ববেশ ধরে ঘুরাঘুরি করবে নাকি!
আর একটি অভিজ্ঞতার কথা বলে শেষ করছি সেটি ঠিক ভাষা না সংস্কৃতির অংশ। শপিং সেন্টার থেকে কনফারেন্সের ভেন্যু গালাধালি হোটেলে ফেরার সময় বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি। যেই বাসকেই জিজ্ঞেস করি গালাধালি হোটেলে যাবে কিনা কন্ডাকটর ডানে বামে মাথা নাড়ে আর কিছু বলেনা। ডানে বামে মাথা নাড়া মানে না, তাই আমরা আর বাসে উঠিনা। এই ভাবে বেশ কয়েকটা বাস চলে গেল। তখন এক শ্রীলংকান এসে বলল যে আমি অনেকক্ষণ ধরেই দেখছি তোমরা বাস আসলেই এগিয়ে যাও কিন্তু বাসে আর উঠ না ব্যাপারটা কি বলবে। বললাম কি করে উঠবো যেই বাসকেই জিজ্ঞেস করি সেই বলে যাবে না। বলল ও কি বলেছে যে যাবেনা। বললাম মুখে বলেনি কিন্তু মাথা নেড়ে না করেছে। তখন ও মাথা নেড়ে দেখিয়ে বলল এইভাবে না করেছে? বললাম হ্যাঁ। তখন সে হো হো করে হেসে বলল এখানে এইভাবে মাথা নাড়া মানে হচ্ছে হ্যাঁ। আহারে জীবন, কত কিছুই না নতুন দেখছি আর জানছি। এ জানার আর দেখার কোন শেষ নাই। এরপরও অজানা রয়েু গেল আমাদের না যদি ওদের হ্যাঁ হয় তাহলে ওদের না কি আমাদের হ্যাঁ!
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি
|