একজন মানুষ কামরুল মান্নান আকাশ
(গত তেইশে অক্টোবর লাকেম্বার গ্রিক ক্লাবে ছিল ডঃ আবদুল হকের সম্মানে আয়োজিত দোয়া ও স্মরণ সভা। সেই মানুষটিকে স্মরণ করে পঠিত আমার এই লেখাটি।)
একজন মানুষের মত মানুষের কথা বলার জন্য আমি আজ আপনাদের সামনে দাঁড়িয়েছি। আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি তাঁদেরকে যারা প্রয়াত ডঃ আবদুল হককে সম্মান জানিয়ে আজকের এই স্মরণ ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। অপ্রিয় হলেও এই কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে কাউকে সম্মান জানানো বা তাঁর কাজের স্বীকৃতি দেওয়ার অভ্যাসটা আমাদের দিন দিন কমে যাচ্ছে। আজকের এই মহতী অনুষ্ঠানটিতে প্রাণের টানে আমরা সবাই ছুটে এসেছি শুধু মাত্র আবদুল হক ভাইকে আমাদের ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা জানাব বলে।
আমাদের সবার প্রিয় “হক” ভাই এখন পরলোকে। মানব জীবন নশ্বর কিন্তু তাঁর চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণা অবিনশ্বর। আমি বিশ্বাস করি কেউ কারো চিন্তা এবং কর্মকে অস্বীকার করলেই তা মিথ্যা হয়ে যায় না। আপনারা, আমি এবং আমরা সবাই জানি তিনি মানুষের জন্যে-মানবতার জন্য কি করে গেছেন এবং কি করতে চেয়েছিলেন। তিনি কোন স্বীকৃতির জন্য বা ব্যক্তিগত লাভের জন্য কোন কাজ করতেন না বলেই আমি জেনেছি, যা করতেন নিজের দায়িত্ববোধ থেকে মনের তাগিদেই করতেন। তাকে সবসময়ই দেখতাম কি করলে এই বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশি জন গোষ্ঠীর সুনাম হবে, মানুষের কল্যাণ হবে, আমদের প্রজন্ম শেষ বয়সে কেমন থাকবে, ভবিষ্যৎ প্রজন্ম কি ভাবে আরও সফলতা লাভ করবে তাই নিয়ে ভাবতে, কথা বলতে এবং কাজ করতে।
আমি যখন উনার কাছাকাছি বসবাস শুরু করি তাঁর আগে পরিচয় থাকলেও সেই ভাবে তাকে জানতাম না। এরপর ২০০২ থেকে ২০১৬ এই সুদীর্ঘ সময়ে নানা সামাজিক, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড ও পারিবারিক যোগাযোগের মাধ্যমে তাঁর সাথে আরও নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠে। শত অভিযোগ অনুযোগ শুনতেন হাসিমুখে। রাগ তো দূরের কথা মুখের হাসিটিও মলিন হতে দেখিনি কোনদিন। কি ধৈর্যশীলই না ছিলেন আমাদের হক ভাই। তাই সব শেষে আবার একসাথেই কাজ করে গেছি আর আমৃত্যু সম্পর্কটি ছিল অটুট।
শত প্রতিকূলতার মাঝেও নিজের লক্ষ্যে ছিলেন অবিচল। তাই তিনি বার বার ছুটে গেছেন মানুষের কাছে, সবাইকে সম্পৃক্ত করতে চেয়েছেন সকল কাজে। চেয়েছেন সবার মাঝে জেগে উঠুক মানবতা, হাত বাড়িয়ে দিক অসহায় আর বিপদগ্রস্ত মানুষের প্রতি। তাঁর ডাকে সাড়া দিয়ে খুলে গেছে অনেক মনের বন্ধ জানালা, উপকৃত হয়েছে মানবতা। প্রতিটি অনুষ্ঠান সফল করে তোলার জন্যে কি পরিশ্রমটাই না করতেন। তিনি ছিলেন সেই নেতৃত্বের গুনে গুণান্বিত যিনি অন্যকে নির্দেশ দেওয়ার চেয়ে নিজেই খাটতেন দ্বিগুণ। মাইক্রোফোন হাতে ঘুরে বেড়ানোর চেয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পড়াতেই যেন ছিল তাঁর অপার আনন্দ।
মানুষের জীবনের সব আকাঙ্ক্ষাই পূরণ হয়না, হক ভাইয়েরও হয়নি। তিনি কিছু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তিনি যে কল্যাণকর কাজগুলো সংগঠিত করতেন সেগুলো তাঁর অবর্তমানে তাঁর মত করে করা হয়ত সম্ভব হবেনা। কিন্তু সবাই মিলে চেষ্টা করলে তা এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন হবেনা। আর সেটা করতে পারলেই তাঁর প্রতি সত্যিকারের সম্মান জানানো হবে।
তিনি কোন মহামানব ছিলেন না, ছিলেন মানবিক গুণাবলী ও অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে ভরপুর একজন সাধারণ মানুষ। তাঁর পরোপকারী, বিনয়ী এবং নিরহংকার ব্যক্তিত্বই তাকে নিয়ে গেছে অসাধারণের উচ্চতায়।
তিনি আজ আমাদের মাঝে নেই। কিন্তু তাঁর অনুপস্থিতিই জানান দিচ্ছে কি প্রবল ভাবেই না তিনি আমাদের মাঝে ছিলেন।
জীবনের কিছুই যায় না হরিয়ে থাকে তাঁরা লুকিয়ে, মনের গহীনে। দিনের আলোয় খুঁজে না পাওয়া রাতের সেই সব তারাদের মত।
আবদুল হক ভাইও আমাদের মাঝে বেঁচে থাকবেন এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের মতন। হাজারো কাজের মাঝে ভুলে গেলেও হয়ত কোন অলস মূহুর্তে মনে পড়বে তাঁর চির হাস্যোজ্জল মুখটি।
সবশেষে দোয়া করি সর্ব শক্তিমান আল্লাহ্ সোবহানুতাআলা যেন তাকে দান করেন বেহেস্তের সর্বোচ্চ স্থান জান্নাতুল ফেরদৌস। আমীন।
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি
|