৩১ অক্টোবর দীপন হত্যার দ্বিতীয় বছর-পূর্তি উপলক্ষে
দীপন তোমার জন্যে ভালবাসা কামরুল মান্নান আকাশ
“যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?”
কি করে বাসব ভালো, কি করে করব ক্ষমা যারা হত্যা করেছে দীপন তোমাকে! চারিদিকে আজ শুধুই অন্ধকার আর বিষ বাষ্পের ছড়াছড়ি। দীপন মানে তো আলোর দ্যুতি, সেই দ্যুতি নিভিয়ে দিল কারা! দীপনের জীবনের আলো নিভেয়ে দীপনের বাবাকে অন্ধ করেছে যারা তাদের কোন ক্ষমা নেই। দীপনের বাবা কাশেম চাচার ছেলের শোকে ক্রন্দনরত ছবি দেখে আমার চোখও ভিজে উঠেছে পানিতে। পারছিনা আর নিজেকে ধরে রাখতে। মনে হচ্ছে আমি যেন দেখছি আমারই বাবার মুখ। এ মুখ বাংলাদেশের প্রতিটি সন্তানহারা পিতার মুখ। একমাত্র ছেলেকে হারিয়ে, এত কষ্ট বুকে নিয়ে কি ভাবে বেঁচে থাকবেন দীপনের বাবা! জীবন থেমে থাকেনা। এক বুক হাহাকার নিয়ে তিনি আজো বেঁচে আছেন। পিতার কাঁধে সন্তানের লাশ নাকি পৃথিবিতে সব চেয়ে ভারী জিনিস! এ শুধু জানেন যিনি সন্তান হারিয়েছেন, আরও বেশী করে জানেন তিনি যার সন্তানকে অকালে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে ধর্মের নামে। মনে হয় চিৎকার করে বলি কিসের ধর্ম, কার জন্যে ধর্ম! কি হবে এই ধর্ম দিয়ে মানুষই যদি না বাঁচে, মানবতা না বাঁচে। সেই সব ধর্মান্ধদের বলি ভালো করে পড়ে দেখ নিজের নিজের ধর্মকে। কোথায় বলেছে আশরাফুল মখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব মানুষকে হত্যা করতে। কি অধিকারে তুমি হত্যা করছ তাঁকে যাকে সৃষ্টি করেছেন সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং! তুমি তোমার ধর্ম কর আমাকে আমারটা করতে দাও। সেই সাথে এও বলি তুমি যদি ধর্মে বিশ্বাস না কর, তুমি যদি বিজ্ঞানের আলোকে ধর্মকে অস্বীকার কর তবে কর। তাতে আমার কোন অসুবিধা নেই কিন্তু আমার ধর্মকে অসম্মান করোনা। তোমার যেমন ধর্ম না করার অধিকার আছে আমারও তেমনি ধর্ম করার অধিকার আছে। তুমি যদি প্রগতিশীল হও,যদি ভিন্নমতে শ্রদ্ধাশীল হও আর যদি মানুষকে ভালই বাস তাহলে তো তুমিও পারনা ধর্মে বিশ্বাসীকে আঘাত করতে। আর যদি তুমি ধার্মিক হও, বিশ্বাসী হও, না দেখেই বিশ্বাস কর সৃষ্টি কর্তাকে তাহলে কি করে তুমি হত্যা কর তোমার ভাইকে, কি করে তাঁর রক্তে রঞ্জিত কর তোমার হাত! চেয়ে দেখ কেমন করে কাঁদছে দীপনের বাবা, কাঁদছে অভিজিতের বাবা। শোকে পাথর হয়ে আছে দীপনের স্রী র, বাক্যহারা সন্তানেরা ভাবছে এ সবই মিথ্যা হয়ত আবার ফিরে আসবে বাবা। কোথায় ধর্ম, কোথায় মানবতা! আজ মনে হয় দুপক্ষই যেন উন্মাদ হয়ে গেছে একে অন্যকে আঘাত করার জন্যে। কেউ আঘাত করছে কলম দিয়ে কেউ আঘাত করছে চাপাতি দিয়ে। কি অশ্লীল সেই কলমের ভাষা আর কি বীভৎস চাপাতির কোপ। একটি কেড়ে নিচ্ছে জীবন আরেকটি কেড়ে নিতে চায় বিশ্বাস। তোমার লেখনী দিয়ে যত পার আঘাত কর ধর্মান্ধতাকে, আঘাত কর ধর্মের অবমাননাকারীকে, ভেঙ্গে দাও এই অচলায়তন! কিন্তু আঘাত করোনা মানুষকে, আঘাত করোনা তার ধর্ম বিশ্বাসকে। কলমের আঘাত অস্ত্র নয় কলম দিয়েই ফিরিয়ে দাও। তোমার কোন অধিকার নেই তোমার বিশ্বাস কিংবা অবিশ্বাস অস্ত্রের জোরে আমার উপর চাপিয়ে দেবার।
আমি সহ্য করতে পারছিনা দীপনের বাবার কান্না। দীপনের বাবা আবুল কাশেম আর অভিজিতের বাবা অজয় রায় দুজনকেই চিনতাম ছোটবেলা থেকেই। উনারা দুজনই ছিলেন আমার বাবার সহকর্মি-বন্ধু স্থানীয়, ছিলেন দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যায়তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। জীবনে অনেক ছাত্রকে পড়িয়েছেন, দিয়েছেন তাঁদের আদর্শের শিক্ষা। কেউ তা গ্রহণ করেছে আর কেউ গ্রহণ করেনি। ভালো ছাত্র হলেই ভালো মানুষ হয়না। যে ক্যাম্পাসের আলো বাতাসে আমি বেড়ে উঠেছি, কেটেছে শৈশব, কৈশোর আর যৌবন মিলিয়ে তিরিশটি বছর সেই একই ক্যাম্পাসে বেড়ে উঠেছে দীপন এবং অভিজিৎও। দীপনকে দেখেছি ছোট বেলায় তাই সেই অর্থে আমি তাঁকে জানতাম না। অতি সজ্জন, আপাদমস্তক নিপাট ভালো মানুষ বাবাকে দিয়েই বুঝতে চেষ্টা করছি তার সন্তান কেমন ছিল। মানুষের উপরে তাঁর পরিবার এবং পরিবেশের প্রভাব অসীম। বিশেষ করে তাঁর শৈশবকাল। অবশ্য এর ব্যতিক্রমও আছে। অনেক ধার্মিক পরিবারের সন্তানকেই দেখছি বড় হয়ে ধর্মকে অস্বীকার করতে। আবার ধর্ম চর্চা করেন না এমন পরিবারের সন্তানকে দেখেছি বড় হয়ে ধর্মকে আঁকড়ে ধরতে। সবারই অধিকার আছে নিজের মত করে ভাববার, নিজের মত করে বাঁচবার। কিন্তু তাই বলে ধর্মতা কিংবা ধর্মহীনতা যে মানুষে মানুষে হানাহানির এত বড় কারণ হয়ে উঠবে সেটা মেনে নেওয়া যায়না। আমদের ক্যাম্পাসে সব ধর্মের শিক্ষকরাই পরিবার পরিজন নিয়ে বাস করতেন, আবার ধর্মে বিশ্বাস করেন না এ রকম অনেক শিক্ষকও ছিলেন। কিন্তু সেখানে ছিলনা কোন বিশ্বাস বা চিন্তার সংঘাত। তাঁরা সবাই ছিলেন নিজ নীতিতে বিশ্বাসী আর স্ব স্ব ক্ষেত্রে সুপণ্ডিত। আমরা বাস করতাম যেন একটি পরিবারের মত। সেখানে ছিল মুক্ত চিন্তা আর মুক্ত বুদ্ধি চর্চার অবাধ ক্ষেত্র। এই পরিবেশে বেড়ে উঠা দীপন আর অভিজিৎ হয়েছিল দুই মতাবলম্বী। দীপন ধর্মে বিশ্বাসী ছিল আর অভিজিৎ ধর্মে বিশ্বাস করতনা। তাই বলে তাঁদের বন্ধুত্বের কিংবা ভালবাসার কোন কমতি ছিলনা। তাঁরা একে অপরের মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিল। তাই দীপন অভিজিতের লেখা প্রকাশ করতে দ্বিধা করেনি। দীপন অভিজিতের মতের সাথে একমত না হলেও তার স্বাধীন ভাবনা প্রকাশ করার জন্যে প্রাণ দিয়ে গেল।
অনেক তথাকথিত প্রগতিশীলকে দেখেছি অন্যের ধর্মের বিকৃত সমালোচনা করতে কিন্তু নিজের ধর্মের সমালোচনা সহ্য করতে পারেন না। তারা অন্য ধর্মকে কটাক্ষ করেন অত্যন্ত নোংরা ভাষায় যা কোন ভাবেই কাম্য নয়। আবার অনেক ধার্মিককে দেখেছি নিজ স্বার্থে ধর্মকে ব্যাবহার করতে। ধর্মের অপব্যাখ্যা করে উসকে দিতে ধর্মিয় হানাহানিকে। আজকের বাংলাদেশে ধর্ম এবং ধর্ম নিরপেক্ষতা এই দুইকেই ব্যাবহার করা হচ্ছে রাজনীতির নোংরা হাতিয়ার হিসাবে।
দীপন নাস্তিক ছিলনা, ছিল মুক্তমনা আর করত নিজ ধর্ম এবং মুক্ত বুদ্ধি দুইয়েরই চর্চা। আমার দৃষ্টিতে নাস্তিক আর মুক্তমনা সমার্থক নয়, যদিও অনেক সময় দুটিকে এক করে দেখা হয়। একজন নাস্তিক বিরাজ করে ধর্ম বিরোধী একটি বিশ্বাস নিয়ে একটি গোষ্ঠীর মধ্যে, এরা কোনদিন সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে না। আর মুক্তমনা বাস করে সবার মাঝে মুক্ত মন নিয়ে। যে পারে ভিন্ন ধর্ম, ভিন্ন মতাবলম্বী নির্বিশেষে সবাইকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে। পারে মানুষকে ভালবেসে মানুষের মাঝে থাকতে। তারাই প্রকৃত ধার্মিক, তারাই প্রগতিশীল।
দীপনের অধিকার ছিল বেঁচে থাকার, অধিকার ছিল মুক্ত বুদ্ধির চর্চার। হয়ত তাঁর আলোতেই আলোকিত হয়ে উঠত বাংলাদেশ।
দীপন তুমি আবার ফিরে এসো এই বাংলাদেশে, যেদিন তাকে আমারা তোমার বাসযোগ্য করে তুলতে পারব। ততদিন তুমি ভালো থেক, তোমার জন্যে রইল অনেক ভালবাসা!
পাদটিকাঃ দুই বছর হয়ে গেল আজো দীপন হত্যার বিচার হয়নি। এ যে কত বড় লজ্জা দেশের জন্যে, এই মনুষ্য জন্মের জন্যে, তা কি আমরা বুঝতে পারছি!
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি
|