আমার বিশ্ববিদ্যালয় কামরুল মান্নান আকাশ
জীবন থেকে কি দ্রুতই না হরিয়ে যাচ্ছে দিনগুলি! মনে হয় এই সেদিন ঢাকা ইউনিভার্সিটি এলামনাই এসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়ার পুনর্মিলনী ২০১৩ তে মিলেছিলাম সিডনীর গ্র্যানভীল টাউন হলে। এরই মধ্যে পার হয়ে গেছে একটি বছর! অন্তহীন ব্যস্ততার মাঝে পুরানো দিনের কথা ভাববারও যেন সময় হয়না। তাই বছর ঘুরে যখন আবার এই সময়টি ফিরে আসে মনের কোথায় যেন একটা পুরানো সুর বেজে উঠে। মনে পড়ে অনেক দূরে ফেলে আসা একটি শিক্ষাঙ্গনের কথা। এটি আমার বিশ্ববিদ্যালয়, এর নাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিন কথা প্রসঙ্গে একজন বলছিল আপনারা যারা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র তাদেরকে কেমন যেন একটু অহংকারী মনে হয়, আমি ওখানে পড়িনি ঠিকই কিন্তু তার চেয়ে অনেক ভালো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি। আমি কি বলব! যার নাম নেই বিশ্বের প্রথম ৫০০ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর তাকে নিয়ে কিইবা বলা যায়! ভাবতে থাকি অসুস্থ রাজনীতির স্বীকার তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নশীল একটি দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়, যার বরাদ্দ জাতীয় বাজেটের ক্ষুদ্র একটি অংশ তাকে কোন মানদণ্ডে তুলনা করা যায় উন্নত বিশ্বের প্রযুক্তি ও আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে। যেখানে অনেক ভালো ভালো গবেষণা প্রকল্প টাকার অভাবে বাস্তবায়িত হয়না। গবেষণাগারগুলোতে নেই আধুনিক যন্ত্রপাতি, নেই যুগোপযোগী প্রযুক্তি। লাইব্রেরীতে নেই পর্যাপ্ত বই, নেই জার্নাল কেনার মত টাকা। এইসব সীমাবদ্ধতার মাঝেও এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হচ্ছে জ্ঞানীগুণী জনের। এর ছাত্ররা বিশ্বের যে কোন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, গবেষণাগারে কিংবা পেশাগত কাজে উন্নত দেশের ছাত্র ও পেশাজীবীদের সাথে সমান তালে কাজ করছে, প্রতিযোগিতায় টিকে থাকছে এবং কোন কোন ক্ষেত্রে তাদেরকে পিছনে ফেলে এগিয়েও যাচ্ছে।
নিঃসন্দেহে শিক্ষার মান, গবেষণা এবং আরো অনেক কিছুতেই এই বিশ্ববিদ্যালয় পিছনে পড়ে আছে। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যে কারণে বিশ্বের আর সব বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আলাদা তা হচ্ছে দেশের প্রতি ও দেশের মানুষের প্রতি এর দায়বদ্ধতা। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের দায়িত্ব কি শুধুই শিক্ষাগ্রহণ নাকি দেশের প্রয়োজনে অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করাও। যদি শিক্ষাগ্রহণই হয় শিক্ষার্থীদের একমাত্র কাজ তাহলে কোন তারুণ্য রুখে দাঁড়াবে অনিয়ম আর অনাচারের বিরুদ্ধে! কে এসে দাঁড়াবে দেশের বঞ্চিত মানুষগুলোর পাশে! প্রতিবাদ আর রুখে দাঁড়ানো মানে তো কেবল মিছিল, ভাংচুর কিংবা সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া নয়। এ হচ্ছে চেতনার লড়াই, মিথ্যার সাথে সত্যের আর অন্যায়ের সাথে ন্যায়ের। ইতিহাস সাক্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কখনোই এই দায়িত্ব পালনে পিছ পা হয়নি। এটাই হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষত্ব, এটাই তাঁর অহংকার।
দ্বিজাতিতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে যে দেশের সৃষ্টি হয়েছিল তা এক সময় এসে দ্বন্ধে জড়িয়ে পড়ে বাঙালি জাতির সংস্কৃতির প্রশ্নে। দেশের দুই অংশের ভাষা, সামাজিক আচার অনুষ্ঠান, সংস্কৃতির চর্চা, উৎসব পার্বণ সব কিছুই ছিল ভিন্ন। এমনকি ধর্মীয় উৎসব ও অনুষ্ঠান পালনের রীতিনীতি ও ছিল ওদের থেকে আলাদা। রাষ্ট্রীয় বাজেটের সিংহ ভাগই বরাদ্দ থাকত অপর অংশটির জন্যে। এই অর্থনৈতিক বৈষম্য সত্যেও দেশের মানুষ তখনো প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে উঠেনি। কিন্তু যখনই আঘাত এসেছে তার ভাষার উপর তার সংস্কৃতির উপর ফুঁসে উঠেছে তাঁরা। আর সহজ, সরল, শিক্ষা বঞ্চিত এই মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান, একাত্তরের স্বাধীনতা আন্দোলন ও নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এর ছাত্ররা। বাঙালির জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এসব আন্দোলনের কথা স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
আমি ভাষা আন্দোলন দেখিনি বইয়ে পড়েছি, শুনেছি আমার বাবার কাছে যিনি তখন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। ১৯৪৮ সালে সদ্য ভূমিষ্ঠ রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেওয়া ভাষাকে মেনে না নেওয়ার প্রথম প্রতিবাদ শুরু হয় এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার আদায় করতে যেয়ে শহিদ হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বরকতসহ আরো অনেকে। সেদিন কেউ ভাবেনি আজকের এই দিনটিই বদলে দেবে বাঙালির সামনের দিনগুলি। ১৯৬১ সালে যখন রবীন্দ্র সঙ্গীত, সাহিত্য ও বাঙালী সংস্কৃতির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, সরকারের রক্ত চক্ষুকে উপেক্ষা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিক্ষকেরা উদযাপন করেছিল রবীন্দ্র জয়ন্তী। এভাবেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির ধারা। আর এই ভাষা ও সংস্কৃতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাই দেশের মানুষকে সচেতন করে তোলে অর্থনৈতিক স্বাধীনতা অর্জনে, যা আস্তে আস্তে রূপ নেয় স্বাধিকার আন্দোলনে।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের পর উনসত্তর থেকে একাত্তরের সেই উত্তাল সময়টুকু ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়। তৎকালীন সরকারের ভিত কাঁপিয়ে দিয়ে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়েছিল এর ছাত্ররা। বিশে জানুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে গুলি চালালে নিহত হয় এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আসাদ। শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে পতাকা বানিয়ে মিছিল করে ছাত্ররা। এই সময় যে সব ছাত্ররা মিছিলে আসত তারা জীবন দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই আসত। তাঁদের পকেটে থাকত ঠিকানা লেখা চিরকুট যাতে মৃত্যুর পর পরিচয় পেতে অসুবিধা না হয়। তাদের এই অমিত তেজ শোককে পরিণত করে শক্তিতে, জেগে উঠে দেশ। বিক্ষোভে প্রতিবাদে ছাত্রদের সাথে সর্বস্তরের জনতাও নেমে আসে ঢাকার রাজপথে, সেই পথ বেয়েই তারা এগিয়ে যায় একটি জাতির চূড়ান্ত মুক্তির লক্ষ্যে। মিছিলে লাঠি চার্জ, গুলি, গ্রেফতার, ১৪৪ ধারা, কারফিউ, হরতাল এসব হয়ে উঠে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যপার। সার দেশ জুড়েই চলছিল এই অবস্থা। এর মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থাকত সবচেয়ে উত্তপ্ত। পল্টন ময়দান, বায়তুল মোকারম এলাকায় রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রদের বড় বড় জনসভাগুলি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এবং শহিদ মিনারই ছিল সকল আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু। ছাত্ররাই ছিল আন্দোলনের অগ্রভাগে। সেই সময়কার ছাত্র নেতৃবৃন্দের সততা এবং দেশপ্রেম নিয়ে কারো মনে কোন সন্দেহ ছিলনা। দেশের মানুষ তাদের নিয়ে অহংকার করত। দূর দূরান্ত থেকে ছুটে আসত তাদের কথা শোনার জন্যে। রাজনৈতিক দল গুলোর মূল চালিকা শক্তিই ছিল এই ছাত্ররা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এর ছাত্ররাই প্রথম উত্তোলন করে আগামী দিনের বাংলাদেশের পতাকা। ছাত্ররাই পাঠ করে স্বাধীনতার ইশতেহার এবং গেয়ে উঠে প্রথম জাতীয় সঙ্গীত। "আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি" উচ্চারণের মধ্য দিয়ে দেশের মানুষের মনে জাগিয়ে তোলে একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের স্বপ্ন। তাই পঁচিশে মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী। নির্বিচারে হত্যা করে ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের। তাদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি নারী ও শিশুরা। স্বাধীনতা সংগ্রামের শুরুতে এবং চূড়ান্ত বিজয়ের আগে রাজাকার আলবদরেরা পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে দেশের সূর্য সন্তান এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের। মুক্তি যুদ্ধে শহিদ হয়েছে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারী। বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ত্যাগ এমনিই মহান। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে পথচলা শুরু হয়েছিল তা এসে শেষ হয় একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।
সেই সময়ে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি নিয়ে বড় আকারের আন্দোলন করলেও এখন যেন কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। এরপরও ১৯৮৩ তে গণ বিরোধী শিক্ষানীতি, নব্বুইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং ২০০৭ সালে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। সরকারী পেটোয়া বাহিনীর মুখোমুখি হয়ে লড়াই করেছে তারা। রুখে দিয়েছে সামরিক বাহিনীকে। যে ছাত্ররা এককালে থাকত গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের পুরোভাগে কোন এক অশুভ শক্তির প্রভাবে তারা যেন আজ দিশেহারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বাংলাদেশের ইতিহাস। সাহসী এই বিশ্ববিদ্যালয় সঠিক সময়ে সঠিক কাজটি করতে ভুল করেনি। এখানে যারা পড়ে তাদের মনে সুপ্ত থাকে বিদ্রোহের বীজ যা অঙ্কুরিত হয় দেশের সংকটকালে। ওরা যখনই রাজপথে নেমেছে, জেগেছে দেশের মানুষ, গড়েছে নতুন ইতিহাস।
আজকের এই অস্থির সময়ে অস্থির বিশ্ববিদ্যালয়কে দোষারোপ করলেও তাঁর গৌরবময় অতীত ম্লান হয়ে যাবেনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বিচ্ছিন্ন কোন দ্বিপ নয়। সারাদেশ যেখানে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের স্বীকার সেখানে কি করে সে থাকবে এই বলয়ের বাইরে! আমরা আশায় বুক বাঁধি একদিন কেটে যাবে এই ক্রান্তিকাল। আসবে নতুন তারুণ্য নতুন আলো নিয়ে। সকল আঁধার ছিন্ন করে উঠবে আবার নতুন সূর্য।
|