জীবনের রং- প্রধান অতিথি যখন প্রধান মন্ত্রী কামরুল মান্নান আকাশ
পিছনে ফেলে আসা অনেক ছবিই কারণে অকারণে মনে পড়ে। আবার কখনো বর্তমানের কোন লেখা বা সংবাদ টেনে নিয়ে যায় অতীতে। এই লেখার কারণও সম্প্রতি পঠিত একটি সংবাদ। সেটা আর উল্লেখ করছি না। তবে এটা আমাকে নিয়ে গেছে অতীতের সেইদিনে, যেখানে আমি এক প্রধান মন্ত্রীকে প্রধান অতিথি হিসাবে বরণ করার আয়োজনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলাম। আর সেই অভিজ্ঞতা সবার সাথে শেয়ার করাই আমার উদ্দেশ্য, আর কিছু না। সেটা ছিল সম্ভবত ১৯৯২/৯৩ সাল আমি তখন বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতির সাংস্কৃতিক সম্পাদক এবং সবচেয়ে তরুণ সদস্য। সমিতির সভাপতি ছিলেন জনাব এস কে এম আবদুল্লাহ। তিনি ছিলেন আমার কর্মক্ষেত্র বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এবং পরবর্তীতে পেট্রবাংলার চেয়ারম্যান। তখন আমি এক তরুণ তুর্কি। প্রতিবাদী এবং স্পষ্টবাদী- কোন কিছুরই পরওয়া করিনা। এই কারণে যারা ভাল লোক তাদের কাছে প্রিয় আর দুষ্টুদের চক্ষুশূল ছিলাম। তবু প্রিয় হওয়ার পাল্লাটাই ছিল ভারী। এর কৃতিত্ব আমার চেয়ে আমার পাশে যে সব বন্ধু, ছোট ভাই, বড় ভাইরা ছিলেন তাদেরই বেশি। তারা সবাই ছিলেন ভাল মানুষ। পৃথিবীর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা সেই সব মানুষেরা আজো আমাকে ভালবাসেন এবং খোঁজ করেন। তারা যখন এই পরবাসে এসে প্রথমেই আমাকে খোঁজেন আনন্দে মনটা ভরে যায়। তাই বলি জীবনে অনেক কিছুই পাইনি কিন্তু সবার অফুরন্ত ভালবাসা সবসময় পেয়েছি। আবদুল্লাহ স্যারও আমাকে খুব আদর ও পছন্দ করতেন। এমন অনেক কথা এবং প্রতিবাদ আমি উনার মুখের উপর বলতাম বা করতাম যা অনেকেই সাহস করতনা। কিন্তু উনি কখনো রাগ করেননি বা আমার ক্ষতি করার চেষ্টা করেননি। সামনেই ছিল বাংলাদেশ ভূতাত্ত্বিক সমিতির দ্বিবার্ষিক সম্মেলন। এই সময় একদিন আব্দুল্লাহ স্যার আমাকে ডেকে পাঠালেন। বললেন এবার প্রধানমন্ত্রীকে প্রধান অতিথি এবং জ্বালানী মন্ত্রীকে বিশেষ অতিথি করলে কেমন হয়। আমি জানতাম প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধের সময় ওনার বাসায় আশ্রয় নিয়েছিলেন ও সেখান থেকে গ্রেফতার হয়েছিলেন, সাথে আবদুল্লাহ স্যারও। তাই তার প্রতি উনার কিছুটা পক্ষপাতিত্ব আছে। আর জ্বালানী মন্ত্রী ছিলেন ভূতত্ত্ব বিভাগে আমার সরাসরি শিক্ষক। আমরা সাধারণত কোন বিশিষ্ট ভূতত্ত্ববিদ বা বিজ্ঞানীকে প্রধান অতিথি হিসাবে আনি। আমি বললাম ব্যক্তিগতভাবে আমি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে আনার পক্ষপাতী নই তাতে নিজেদের মাঝে বিতর্ক তৈরি হয়। কিন্তু উনি যেহেতু প্রধানমন্ত্রী তাই আসলে হয়ত ভালই হবে। আর আমরা তাঁর কাছে আমাদের ভূতত্ত্ববিদদের চাকুরী এবং পেশা সংক্রান্ত সমস্যাগুলি তুলে ধরতে পারব ও সহযোগিতা চাইব। তিনি বললেন ঠিক আছে। জিওলজিকেল সার্ভে অব বাংলাদেশে (জি এস বি) আমাদের এবং ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (ওয়াপদা) ভূতত্ত্ববিদদের চাকুরী নিয়ে কিছু জটিলতা ছিল। ভাবলাম এবার হয়ত সমাধান হবে। আমার উপর দায়িত্ব পড়ল একটি জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করার। কিন্তু বাজেট আবার কম। আমাকে বলা হল উনি তাজা ফুল খুব ভালবাসেন তাই প্রচুর ফুল থাকতে হবে গাছসহ এবং কাছাকাছি যারা থাকবে তাদেরকেও হতে হবে স্মার্ট এবং সুন্দর। এর কারণ উনি সুন্দরের পূজারী। আবদুল্লাহ স্যার যতটুকু বলছিলেন তার চেয়ে আরও বেশী বলছিলেন জি এস বি র তোষামোদকারী এক পরিচালক।
সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য স্থান নির্বাচন করা হয় ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তন। আর্ট কলেজ এবং এর হোস্টেল ছিল আমার আড্ডা-স্থলের একটি। আমার বন্ধুরা ততদিনে বেড়িয়ে গেছে কিন্তু ছিল অনেক ছোট ভাই, ওদেরকে বললাম খুব সুন্দর করে মঞ্চ এবং পুরো এলাকা সাজাতে হবে যাতে শিল্পের ছোঁয়া থাকে। টাকা বেশী দিতে পারবনা কিন্তু প্রচুর ভালবাসা আর শুভ কামনা পাবি। ওরা হৈ হৈ করে উঠল আকাশ ভাই আপনি আমাদের সাথে থাকলেই হবে, শুধু চা, সিগারেট আর নাস্তা খাওয়াবেন। আপ্লুত হয়ে গেলাম ওদের ভালবাসায়। এরপর গেলাম রমনা পার্কে ফুল গাছ ভাড়া করতে একেকটা ফুলসহ গোলাপ গাছের ভাড়া দশ টাকা করে। আমার লাগবে প্রায় দুইশত টব – অনেক টাকা, বাজেট ফেল। কি করি, খুঁজে বের করলাম নাসির চাচাকে যিনি ছিলেন রমনা পার্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী এবং আব্বার প্রচণ্ড ভক্ত। উনাকে বললাম বাজেটের কথা, বললেন তোমার যত ফুল এবং টব লাগে নিয়ে যাও টাকা লাগবেনা।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য বলতে গেলে কোন বাজেটই নেই। শুরু করলাম অনুরোধের আসর, পরিচিত শিল্পীদের কাছে যেয়ে যেয়ে। প্রথমে গেলাম শিল্পকলা একাডেমীর সঙ্গীত বিভাগের পরিচালক আলিমুজ্জামান ভাইয়ের কাছে, যিনি নাকি আমার ভূতত্ত্ব বিভাগের বন্ধু কচির বড় ভাই। উনি অল্প কিছু টাকার বিনিময়ে ঠিক করে দিলেন জিন্নাহ ভাইকে যাকে বলা হত বাংলাদেশের ভূপেন হাজারিকা। আর সাউন্ড সিস্টেম ভাড়া নিলাম সেখানকারই তবলচি চন্দনের কাছ থেকে সাথে তার ফ্রি তবলা বাদন। ভূতত্ত্ব বিভাগের ছোট ভাই শওকতের বড় ভাই সারওয়ার ভাই ছিলেন শিল্পকলার নৃত্য শিল্পী। উনি রাজী হলেন নাচতে এবং সঙ্গে নিয়ে আসবেন শিবলী মোহাম্মদ, জিনাত বরকত উল্লাহ আর দীপা খন্দকারকে। বন্ধু অপুর বউ কাজী রুবিনা আহমেদ মিলিকে বললাম আধুনিক গান গাইতে। মিলির কথা একটু বলি ও ছিল তখনকার একমাত্র টিভি চ্যানেল বাংলাদেশ টেলিভিশনের এ গ্রেডের উচ্চাঙ্গ সংগীত শিল্পী এবং নিয়াজ মোহাম্মদের ছাত্রী। ও আধুনিক গান করে না, কিন্তু যদি করত তবে দেশের সেরাদের একজন হতে পারত। আমার অনুরোধে রাজী হল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছোট ভাই বোতল শাহিনের বউ চন্দন গাইবে পুরানো দিনের গান, সেও বি টি ভি র নিয়মিত নজরুল গীতি শিল্পী। এখানেই শেষ না। আর্ট কলেজের ছোট ভাই মিঠু আর তার দলবল তখন খুব নাম করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়ে। ওরা নিজেরাই গান লিখে, সুর করে এবং গায়। মিঠু বলল আমরা আপনার অনুষ্ঠানে গাইব শুধু দুইশ টাকা দেবেন আমাদের অন্ধ দোতারা বাদকের জন্য। সেই ধারা এখনো চলছে এই সুদূর সিডনিতেও, আমাদের সংগঠন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এ্যাসোসিয়েশন অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অনেকেই গান গেয়ে দিয়ে যাচ্ছে অনুরোধে।
সেগুনবাগিচার অফিস থেকে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাসায় ফেরার পথে আর্ট কলেজে ঢুকি, চা, সিগারেট খাই, আড্ডা মারি আর ওদের কাজ দেখি। একদিন যেয়ে দেখি ওরা সব কাজ কাম ফেলে দিয়ে রাগে ফুঁসছে, জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার। বলল, আকাশ ভাই হাবিলদারের মত এক লোক আইসা কয় আমাদের কাজ নাকি ঠিক হচ্ছে না, ঠিক মত করতে। মনে হচ্ছিল তুইলা আছাড় মারি কিন্তু আপনার নাম কওয়াতে কিছু কই নাই। আমি বুঝে ফেললাম এ হচ্ছে জি এস বি র সেই তোষামোদকারী। বললাম সে আর আসবে না এবং আবদুল্লাহ সাহেবকে বলে সেই ব্যবস্থা করলাম। অনুষ্ঠানের আগের রাতে ইঞ্জিনিয়ার্স ইন্সটিটিউট মিলনায়তনে সব নিয়ে হাজির হল আর্ট কলেজের ওরা। ছোট বাবুর তদারকিতে চলতে লাগল যে সব উপকরণ বানিয়ে এনেছে সেগুলো স্থাপন এবং অলঙ্করণ করার কাজ। বলল সারা রাত লেগে যাবে ওদের। আমিও ওদের সাথে থেকে গেলাম উৎসাহ দেওয়ার জন্য, যদিও ওরা আমাকে বার বার বলছিল বাসায় চলে যেতে। এর মধ্যে আবদুল্লাহ স্যার, সাধারণ সম্পাদক মইনুল ভাই সহ আরও অনেকেই আসলেন কেমন কাজ হচ্ছে দেখতে। সবার জন্য রাতের খাবার কিনিয়ে আনালাম এবং সবাই মিলে খেলাম। যাবার সময় উনি কেমন যেন ইতস্তত করতে লাগলেন এবং আমার পিঠে হাত রেখে গভীর কণ্ঠে বললেন তোমাকে একটা কথা বলি রাগ করোনা। বললাম, বলেন স্যার। তখন বললেন, ওনাকে বলা হয়েছে কোন দাবী দাওয়া বা সমস্যার কথা প্রধান মন্ত্রীর সামনে বলা যাবেনা কাজেই আমারা যেন কিছু না বলি। প্রচণ্ড হতাশ হয়ে বললাম তাহলে তাকে এনে আমাদের কি লাভ হল, আমি এখনি সব ফেলে চলে যাব! উনি আমার হাত ধরে বললেন জ্বালানী মন্ত্রীর সাথে কথা হয়েছে, এটা নিয়ে আমরা কাজ করব। ভেবে দেখলাম এখন রাগ করে কোন লাভ নেই কারণ সুন্দর অনুষ্ঠান না করতে পারলে সেটা হবে আমাদের সম্মানের ব্যাপার।
সব কাজ শেষ করে ভোর চারটা সময় বাসায় গেলাম এবং আবার সাতটায় এসে হাজির হলাম। এসে দেখি সিকিউরিটির লোকজন গিজ গিজ করছে। সাদা পোশাকের কর্নেল বা মেজর র্যা ঙ্কের দুজন এসে বলল আপনারা তো এখনো কাজই শেষ করেননি, চেয়ার নেই-কার্পেট নেই! আমি অবাক হয়ে বললাম মানে! সবই তো আছে। ওরা বলল প্রধান মন্ত্রী কি এই সব চেয়ারে বসবেন নাকি, ওনার জন্য আনতে হবে স্পেশাল চেয়ার। সেটা একমাত্র হাজী চাঁন মিয়া ডেকোরেটরের কাছে পাওয়া যায়। আর গাড়ী থেকে নেমে স্টেজ পর্যন্ত হেঁটে যাবার পথটুকু লাল গালিচা দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। শুনে আমার আক্কেল গুড়ুম! বললাম আমাকে তো এ সব কেউ জানায়নি। বলল এটা জানানোর কিছু নেই সবাই জানে। যতক্ষণ এসবের ব্যবস্থা না হবে তিনি আসবেন না। এখন এই ভোর বেলা কোথায় পাই এই সব। বললাম জ্বালানি মন্ত্রী আমার শিক্ষক এবং কাছের মানুষ তাঁর সাথে কথা বলছি। জানাল কোন লাভ নেই, আমরা ক্লিয়ারেন্স না দিলে প্রধানমন্ত্রী বাসা থেকে বেরই হবেন না। তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে আমার খুব রাগ হল, বললাম উনি তো জনগণেরও নেত্রী যখন গ্রামে গঞ্জে যান তখনও কি এই সব নিয়ে যান সাথে করে!
যাই হোক ফোন করলাম হাজী চাঁন মিয়ার ছেলে হোসনী দালানের জিন্নুকে, যে নাকি আমাদের ছোট বেলার বন্ধু। ওকে ঘুম থেকে উঠালাম সব শুনে খাস ঢাকাইয়া ভাষায় বলল “কোন চিন্তা করিছ না দোস্ত, অহনই পাঠায়া দিতাছি”। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম, তবে মনের মধ্যে খচ খচ করতে লাগল অনর্থক কিছু টাকা খরচ হল বলে। এরপর জানতে চাইল খাবারের ব্যবস্থা কি করেছি? বললাম ঢাকার সর্বোৎকৃষ্ট স্ন্যাকসের ব্যবস্থাই করেছি হোটেল পূর্বানী থেকে। ওরা যেন চমকে উঠল বলল উনাকে তো ফাইভ স্টার হোটেলের খাবার না হলে দেওয়াই যাবে না। আরও বলল বিভিন্ন সংস্থার গোটা দশেক লোক সেই খাবার আগে খেয়ে দেখবে তা প্রধান মন্ত্রীর জন্য নিরাপদ কি না। কি আর করা ফোন করলাম ফাইভ স্টার হোটেল সোনারগাঁও এর এসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার এক বন্ধুকে। ওকে মেনু বলে দিয়ে লোক পাঠালাম। খাবার আসলে শুরু হল সেই সব দামী খাবার খাওয়ার আর পরীক্ষা করার পালা। সে এক দেখার মত দৃশ্য - সিভিল সার্জন, ব্যক্তিগত স্টাফ, এস পি, স্পেশাল ব্রাঞ্চ, ডি, জি, এফ আই, সহ আরও কয়েকটি সংস্থার লোকজন। খাবার শেষে তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে তুলতে তারা জানাল সব ঠিকই আছে। মনে হল এরা সবাই যেন সকাল থেকে না খেয়ে ছিল এই খাবারের জন্যে...
পরের অংশ
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি
|