জীবনের রঙ - দেশান্তরিত মানুষ কামরুল মান্নান আকাশ
মানুষ ধর মানুষ ভজ শোন বলি রে পাগল মন। মানুষের ভিতরে মানুষ করিতেছে বিরাজন।।
জীবনের চলার পথে প্রতিনিয়ত কত মানুষই না দেখি! লালন ফকিরের ভাষায় মানুষের ভিতরে যে মানুষ থাকে কজনই বা তাকে দেখতে পাই! ভিতরের মানুষকে দেখতে হলে তাকে বাসতে হয় ভাল, তবেই মিলে তাঁর দেখা।
আমি কাজে যাই বাসে, ট্রেনে করে, ড্রাইভ করিনা। এতে করে অনেকটা সময় পাই বই পড়ার আর মানুষ দেখার। কত রঙের, কত ঢঙের মানুষ দেখি। বাইরে থেকে কারও ভিতরটা দেখা যায়না বোঝাও যায় না। কারও সাথে কথা হয়, হলকা বন্ধুত্বও হয়ে যায়। কারও সাথে শুধু হয় হাসি বিনিময়। অন্তরে যাই থাক এখানে চোখে চোখ পড়লে সবাই একটা চমৎকার হাসি উপহার দেয়, ব্যতিক্রম শুধু স্বদেশীরা। আমরা অপরিচিত দেশ-ওয়ালাদের দেখলে গম্ভীর হয়ে নিজের ব্যক্তিত্ব দেখাতে পছন্দ করি। দুটোই দুই সংস্কৃতির ধারক। বিদেশে সব জায়গাতেই এই হাসির চর্চা দেখেছি। আমার জীবনসঙ্গিনী মিনি আমাকে গম্ভীর বলে, সেই আমারও হাসি পেতে এবং দিতে ভালই লাগে। আর মিনির মুখে তো সারাক্ষণ হাসি লেগেই থাকে, এ আমার এক পরম পাওয়া!
হাসির প্রসঙ্গে মনে পড়ল আমি যখন পড়াশোনার জন্য নেদারল্যান্ডে ছিলাম, আমার সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট ভাইও ছিল। ও প্রায় দিনই প্রচণ্ড উচ্ছ্বাস নিয়ে বলতো, ক্লাসে যাওয়ার পথে একটা ডাচ মেয়ে নাকি ওকে দেখলেই হাসে। ওর ধারনা মেয়েটা তার প্রেমে পড়েছে। আমি বুঝাতে চাইলাম এটা ওদের সংস্কৃতির অঙ্গ। কিন্তু ও তখন নতুন রোমান্সের উত্তাপে রোমাঞ্চিত আমার কথা কানে তুললনা। একদিন দুপরে লাঞ্চ ব্রেকে খেতে এসেছি আমাদের নিবাস ডিশ হোটেলে। রিসেপশন থেকে চাবি নিচ্ছি এমন সময় ও দৌড়ে ভিতরে ঢুকল। জিগ্যেস করলাম দৌড়াচ্ছ কেন। ও যা বলল শুনে আমি সশব্দে হেসে উঠলাম। ঘটনা হল যে মেয়েটি তার ভাষায় তার প্রেমে পড়ছে সেই মেয়েটি আজ ওর দিকে তাকিয়ে হাসতেই ও হিরো সিনেমার “পেয়ার করনে ওয়ালে কভি ডরতে নাহি” গানের কথা মনে কর মাহা সাহস নিয়ে (এমনিতে ও ভিতু) মেয়েটির দিকে ফ্লাইং কিস ছুড়ে দেয়। আর তাতেই ঘটে বিপত্তি। মেয়েটি তার দিকে তেড়েমেরে ছুটে আসে আর ও “চাচা আপন প্রাণ বাঁচা” বলে ঝেরে দৌড়। আমি মজা করে বললাম তুমি কিছু দিন আর ওই পথে ক্লাসে যেওনা, বলা যায়না তোমাকে দেখলে পুলিশ ডাকতে পারে। প্রেমিক পুঙ্গবের সেখানেই হয় প্রেমের সমাধি।
সে যাই হোক ফিরে আসি বর্তমানে। অফিসে যাওয়ার পথে স্টেশনের বাইরে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে এক কাপ ধূমায়িত কাফি হাতে নিয়ে সিগারেটে টান দিতে দিতে আমার দিন শুরু হয়। শীতের সকালের নরম রোদে বসে এই সময়টা খুব উপভোগ করি। চেয়ে চেয়ে দেখি দিন শেষে বিধ্বস্ত নগরী ও প্রকৃতির রাতের ঘুম ভেঙ্গে জেগে উঠা, শিশিরে ধোয়া চকচকে কুমারী রূপ। এক অনাবিল ভাল লাগায় মন ভরে উঠে। একদিন এসে দেখি আমার বসার জায়গাটা দখল হয়ে গেছে। এক বয়স্কা মহিলা দোকান দিয়ে বসেছে হাতে বুনা বিনি, গ্লাভস, মোজা, মাফলার এইসবের। আর সে বসে বসে উল বুনছে। আমি কিঞ্চিৎ বিরক্ত হলাম আমার জায়গা দখল হয়ে যাওয়ায়। একটু দূরে গিয়ে বসলাম। একটু পরে সে আমার কাছে এসে রাজ্যের আলাপ জুড়ে দিল। প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও কখনো বিনি, গ্লাভস বা মাফলার কিনি, সে খুব খুশি হয়, হয়ত কিছু আর্থিক সহায়তাও হয়। তার নাম মারিয়া, বয়স প্রায় পঁচাশি। খুব অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছে, স্বামী মারা গেছে, ছেলে মেয়েরা বড় হয়ে যে যার মত চলে গেছে, মাঝে মাঝে খোঁজ নেয়।
মারিয়া জন্মেছিল ইটালির এক প্রত্যন্ত গ্রামে যেখানে অভাব ছিল নিত্য সাথী। গ্রামের লোকদের একমাত্র আয়ের উৎস ছিল জলপাই বাগান। ছোট বেলায় অন্যের বাগান থেকে জলপাই চুরি করে বেড়াত। একদিন ধরা পড়ে যায়। বাগানের মালিক তাকে গভীর জঙ্গলে এক বাড়িতে আটকে রাখে। খবর পেয়ে মারিয়ার বাবা ছুটে আসে তাঁর বন্দুক নিয়ে। মারিয়াকে ছেড়ে দিতে অনুরোধ জানায় মালিককে। কিন্তু সে রাজী তো হয়ই না উল্টা বাজে ইঙ্গিত করে তাঁর মেয়েকে নিয়ে। ওর বাবার মাথায় রক্ত উঠে যায়, গুলি চালায় বাগানের মালিককে। সে মরল না বাঁচল মারিয়া জানেনা। ওর বাবা পরিবারের সবাইকে নিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। কিছুদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়িয়ে একদিন চড়ে বসে জাহাজে। ছোট্ট জাহাজের খোলে বসে উত্তাল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এসে নোঙর ফেলে অস্ট্রেলিয়ার উপকুলে। শুরু হয় এক দেশান্তরিত পরিবারের জীবন সংগ্রামের গল্প। অচেনা মাটিতে এক নতুন জীবন। এখানেও জীবন সহজ ছিলনা, অনেক প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ইংরেজি না জানার কারণে সমস্যায় পড়েছে। স্কুলে মুখ থেকে নিজের ভাষা বেরিয়ে যেত আর হতে হত বুলির শিকার। ওকে থামানোর জন্য একদিন শিক্ষিকা তার মুখ আটকে দেয় স্কচ টেপ দিয়ে। ওর মা ওকে নিতে এসে মেয়ের অবস্থা দেখে কেঁদে ফেলে। বাবা শুনে শুধু বলল এটা যদি ইটালি হত আমি আবার গুলি চালাতাম। তারপরও এখানে এসে ওরা সবাই খুশি। অস্ট্রেলিয়া ওদের দিয়েছে অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও আর্থিক নিরাপত্তা। যেখানে ইটালিতে খাবার যোগাড় করতেই বেগ পেতে হত। বাবাকে নিয়ে মারিয়ার ভীষণ অহংকার। আর অহংকার করবেই বা না কেন, যে বাবা তাঁর মেয়ের জন্য গুলি চালাতেও দ্বিধা করেনি।
সকালে দেখা হলেই ফোকলা হাসি দিয়ে শুভ সকাল জানিয়ে জানতে চায় কেমন আছি। মাঝে মাঝে আমাকে তার দোকান পাহারায় রেখে কফি কিনতে যায়। আমাকে কফি খাওয়াতে চায়, ব্যাগ থেকে বিসকুট বের করে দেয়। আমিও মাঝে মাঝে ওর জন্য কফি-কেক কিনি। এই ভাবেই এক ধরনের মায়া জন্মায়। মনে করিয়ে দেয় আমার মায়ের কথা। তখন মনে হয় ধর্ম, বর্ণ, জাতির কোন ভেদাভেদ নেই মায়ের ভালবাসার কাছে। পৃথিবীর সব মায়েরাই এক, সব ভালবাসার রঙও একই। আজ যখন আমাকে বিস্কুট দিতে এল, বললাম আমি নাস্তা করে এসেছি তাই কফির সাথে কিছু খাবোলা। ও পাশে বসে কফি খেতে খেতে বকবক শুরু করল, আমি খুব ভাল রাঁধি এবং তোমাকে খুব খাওয়াতে ইচ্ছে করছে আমার রান্না। হেসে বললাম ঠিক আছে খাব একদিন তোমার রান্না। ও মলিন মুখে বলল আমার সাথে থাকে আমার ছোট ছেলে আর তাঁর আছে সিজোফ্রেনিয়া, তোমাকে দেখলেই মারতে আসবে। বললাম তাহলে তোমাকেই একদিন নিয়ে আসব আমার বাড়িতে, আমার স্ত্রীও খুব ভাল রান্না করে। করুণ মুখ করে বলল কে জানে সেটাও হবে কিনা! তারপর বলল বড় মেয়েটার বিয়ে হয়েছে অনেক দূরের গ্রাম এলাকায়। ওদের নিজের খামার আছে চাষবাস ও পশুপালন করে। আগে দুয়েক বছর পর পর আসত কিন্তু গত চার/পাঁচ বছর ধরে আর আসতে পারেনা অসুস্থতার কারণে। ও খুব ভালবাসে আমাকে তাই নিয়মিত চিঠি লেখে আর আমাকে যেতে বলে। বলেই পকেট থেকে মেয়ের চিঠি বের করে দেখায়। তারপর হঠাৎ করেই বলে তুমি কি আমাকে নিয়ে যেতে পারবে, এত দূরের পথ আমি একা যতে সাহস পাইনা। আমি পড়লাম সংকটে, না করলে কষ্ট পাবে আবার অচেনা এক ভিন্ন সংস্কৃতির পারিবারিক ব্যাপারে নাক গলাতেও মন সায় দিচ্ছেনা। তবু মারিয়ার ছল ছল চোখ-মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম অবশ্যই নিয়ে যাব, যদিও আমি নিশ্চিত ছিলাম না। আর তাতেই মারিয়া ভীষণ খুশি। এরপর কিছুদিন খুব ভয়ে ভয়ে ছিলাম কখন আবার নিয়ে যাবার কথা বলে। কিন্তু ও আর এর উল্লেখ করলনা।
আরেকদিন গল্প করছি, মারিয়া জানতে চাইল আমার কথা। বললাম আমার দেশে থাকার গল্পটা তোমার চেয়ে ভাল, ভালই ছিলাম দেশে, কিন্তু কেন যে এলাম সেটা আমি নিজেও ঠিক জানিনা। প্রথম এসে মাস খানেক ছিলাম। তারপর ফিরে যাই দেশে এই ভেবে যে বেড়াতে আসলেও বিদেশে কখনও স্থায়ী আবাস গড়ব না। তিন বছর পর ফিরে এলাম। এসেই আবার দিন দশেক পর দেশে ফিরে যেতে চাইলাম, কিন্তু বাদ সাধল মিনি। বলল তোমার এই আসা আর যাওয়ার পর্ব বন্ধ করতে হবে, এতে ছেলে মেয়ের পড়াশোনার ক্ষতি হচ্ছে। কি আর করা সেই থেকে রয়েই গেলাম এই দেশে। একেই বলে কপালের লিখন না যায় খণ্ডন! আর এখানকার গল্পটা তোমার মতই জীবন সংগ্রামের, যা নাকি প্রতিটি দেশান্তরিত মানুষের গল্প। শূন্য থেকে শুরু করে এখন ভালই আছি। কিন্তু যা হারিয়ে ফেলেছি তা আর কোনদিন ফিরে পাবনা - তা হল আমার মা আর আমার দেশ। তোমার মতোই এক মা কে রেখে এসেছিলাম। প্রতিদিন তাঁর জন্য কাঁদতাম, সেও কাঁদত কিন্তু আমাকে বুঝতে দিত না। ফোন করলেই জিজ্ঞেস করত কবে আসব দেশে, কবে আসব তাঁর কাছে। তখন আমি জীবন সংগ্রামে রত, ঝড়ে পড়া এক জাহাজের নাবিক। ইচ্ছা করলেই ছুটে যাওয়া যায়না। আব্বা আম্মাই এখানে এসে কয়েকবার আমাকে দেখে গেছেন। ঢেউয়ের পর ঢেউ পারি দিয়ে আমার জাহাজ যখন তীরে ভিড়ল, শক্ত মাটিতে পা রাখলাম কিন্তু এরপর মা আর বেশীদিন থাকলেন না। আমাদের মায়া কাটিয়ে, এই সংসারের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন স্রষ্টার কাছে। এখন আর মায়ের মত করে কেউ ডাকেনা, কেউ বলেনা কবে আসবি বাবা। মা-বাবা চলে যাওয়ার পর দেশও যেন আর আগের মত ডাকেনা। অথচ এখানে আসার পর প্রতিটি দিন সকালে ঘুম ভেঙ্গে দেশের কথা মনে করে চোখ দিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ত আর মনের গভীর থেকে গেয়ে উঠতাম “ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা”। দেশে থাকতেও এটি ছিল আমার প্রিয় গান। কিন্তু এমন করে পরানের গহীনে নাড়া দিয়ে যেত না। বিদেশে না এলে হয়ত বুঝতামইনা দেশটাকে কতটা ভালবাসি!
মারিয়া আমার পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বলল মন খারাপ কর না। জীবনটাই এমন, কেউই চিরদিন থাকেনা, একসময় বিদায় নিতেই হয়। যতদিন থাক আনন্দে থাক। আমি মারিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকি আর দেখি মানুষের ভিতরের মানুষটাকে! জিজ্ঞেস করলাম তোমার সাথে কি একটা ছবি তুলতে পারি, আমার পরিবারের সবাইকে দেখাব। ও হেসে বলল আমার তো বয়স হয়ে গেছে, চামড়া কুঁচকে গেছে, দাঁত পড়ে গেছে আমার সাথে ছবি তুলে কি হবে! বললাম আমি ছবি তুলছি এক মায়ের সাথে, মায়েরা কখনো বুড়ো হয়না। মারিয়া ফোকলা হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে পোজ দিল। আর বলল আমাকে ছবিটা পাঠিয়ে দিও। ভাল থেক মারিয়া, অমলিন থাকুক তোমার হাসি, মায়ের হাসি।
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি
|