bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia













জীবনের রঙ – বন্ধুর বিয়ে
কামরুল মান্নান আকাশ



মাঝে মাঝে কোত্থেকে যেন এক ঝলক বাতাস এসে ঝাপটা দিয়ে যায় মনের জানালায়। কপাট খুলে দিতেই উড়িয়ে নিয়ে যায় সেই সময়ে যখন আমার আকাশ ছিল গভীর নীল, নদীতে ছিল উত্তাল ঢেউ আর চোখে ছিল স্বপ্ন রঙিন। তখন বসন্তকাল, ছিল অফুরন্ত প্রাণশক্তি আর বুক ভরা সাহস। ছিলাম দুরন্ত, দুর্বার, দামাল প্রাণ এক। তাই প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনে অনেকেই আমাকে কাছে পেতে চাইত। তদের বিশ্বাস ছিল আমি পাশে দাঁড়াবো এবং আমার পুরোটা দিয়েই চেষ্টা করব। জীবনের এই পর্বে এসে বলতে পারি আমি আমার শত্রুকেও বিমুখ করিনি। অনেকবারই ভেবেছি এই শিরনামে আমার প্রিয় বন্ধুর বিয়ে নিয়ে লিখব। কারণ এ ছিল এক অন্য রকমের বিয়ে। ওর অনুমতির অপেক্ষায় দিন গুনেছি। কিন্তু তাকে আর খুঁজে পাইনা, না ফোনে, না ফেসবুকে। অপত্যা কিছুটা রেখে ঢেকে লিখতে হচ্ছে। নামগুলো বদলে দিচ্ছি। এইসব যারা জেনেছিল তারা বুঝবে। যদি কখনো তার চোখে পড়ে ক্ষমা পাবো জানি।

সামনেই ছিল পরীক্ষা, বাসায় বসে পড়ছি। শুনতে পেলাম কেউ আমার নাম ধরে ডাকছে। আমরা তখন থাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈসা খান রোডের শিক্ষক নিবাসে, ২৮ নম্বর বিল্ডিঙের তিন তলায়। ডাক শুনে বারান্দায় এসে দেখি ছোটবেলার বন্ধু দিপু ডাকছে। ওকে উপরে আসতে বললাম। ও বলল জরুরী দরকার নীচে আসো। আমি ভাবলাম বেটা নিশ্চয়ই কোথাও গণ্ডগোল করে এসেছে এখন আমাকে তার সাথে যেতে হবে। এ রকম অনেক হয়েছে। একটু বিরক্ত হয়ে বললাম আমি নামতে পারবোনা পরীক্ষার পড়া করছি, তুমি উপরে আসো। ও আবার অনুনয় করে বলল আসো দোস্ত জরুরী কথা আছে। অপত্যা নীচে নামলাম। দিপু ছিল বিশাল দেহের অধিকারী, ছয় ফুটের উপ লম্বা এবং তেমনই স্বাস্থ্য। সিগারেট খাচ্ছে আর ওর হাত ঈষৎ কাঁপছে উত্তেজনায়। আমি হালকা ভাবে বললাম কি হইছে মাইর খাইয়া আসছো নাকি, তুমি তো একলাই চার-পাঁচজনকে কুপোকাত করতে পারো! বলল না অন্য ব্যাপার, চলো বসি। ওকে নিয়ে আমাদের পাড়ার পার্কের বেঞ্চিতে যেয়ে বসলাম।

দিপু বলল আমাকে ওর সাথে এখনই যেতে হবে কারণ ও আজ বিয়ে করতে যাচ্ছে মিতুকে। গতকালকেই আমি-মিনি, দিপু-মিতু সহ গোটা বিশেক বন্ধুরা মিলে সারাদিন কাটিয়েছি বাংলা একাডেমীর মেলায়। বললাম হঠাৎ কি এমন হল! বলল মিতুকে ওর মা বাসায় আটকে রেখেছে এবং অন্য কারও সাথে বিয়ে দিবে বলেছে। ওর মা জেনেছে ওদের সম্পর্কের কথা এবং কোন ভাবেই মেনে নিবেন না। আমাদের বয়স তখন একুশের কোঠায়। মিতুর আরও কম, ও পড়ে বাংলায়। অথচ মিতু ও দিপুর পরিবারের যে অবস্থান তাতে প্রেমের সম্পর্ক মেনে না নেওয়া কিংবা পড়াশোনা শেষ না করে মেয়েকে বিয়ে দেওয়া অস্বাভাবিক।

দিপুর বাবা এবং আমার বাবা বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকে বন্ধু। ওর বাবা পড়ত আর্ট কলেজে আর আমার বাবা প্রাণরসায়নে। এখন আমার বাবা অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী আর ওর বাবা চিত্রকর ও কুটির শিল্প সংস্থার প্রধান নকশা-বিদ। ভাষা আন্দোলনের সময় একসাথেই ছিলেন এবং সেইসব কথা উনার কাছে শুনেছি। তবে উনি অনেক বেশী সক্রিয় ছিলেন। শহীদ মিনারের পিছনে যে লাল সূর্যটা আজ আমরা দেখি সেটা উনারই সংযোজনা। ভাষা-সৈনিক হিসাবে একুশে পদক পেয়েছেন। মিতুর বাবা ছিলেন পুলিশের ডি, আই,জি আর তখন পাসপোর্ট ও ইমিগ্রেশনের মহাপরিচালক এবং ইয়াং প্যাগাসাস ক্রিকেট ক্লাবের প্রেসিডেন্ট। মা শিক্ষিকা, বেথুন কলেজে পড়া স্মার্ট ও কড়া মহিলা। মেয়েকে গান শিখিয়েছেন নিয়াজ মোর্শেদ সহ অনেক নামকরা ওস্তাদের কাছে। মিতু তখন বেতার ও একমাত্র টেলিভিশন চ্যানেল বি টি ভি র নিয়মিত এ গ্রেডের গায়িকা। ও করত রাগ ও উচ্চাঙ্গ সংগীত। কিন্তু যদি সঙ্গীতের অন্য কোন শাখায় গাইত তবে দেশ-সেরাদের একজন হতে পারত। দুই পরিবারই উদার ও একই সামাজিক অবস্থানে। তখনই ভাবনায় এলো কেন মিতুর মা রাজী না ওদের ব্যাপারে। এর কারণ দিপু নিজেই। ও ছিল পরোপকারী, বন্ধু-অন্ত প্রাণ, প্রাণবন্ত এক ছেলে। কিন্তু ছিল প্রচণ্ড জেদি ও একরোখা। বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু রাগ করে পড়া ছেড়ে দেয়। তখন ওকে চাকুরী দেয় ওর বাবারই এক বন্ধু তার নামকরা স্থাপত্য সংস্থার ডিজাইন সেকশনে। ওকে ভালো বেতন দিত এবং ছিল অবাধ স্বাধীনতা। দিপুই তখন আমাদের মধ্যে একমাত্র চাকুরী করত এবং খরচও করত আড্ডায় এসে।

দিপু জানালো কেরানীগঞ্জে ওর দাদা বাড়ীতে যাবে এবং সেখানেই বিয়ে হবে। বলল ওর পকেটে আছে তখন মাত্র দশ টাকা (পরে ও এই নিয়ে বড়াই করত যে পকেটে দশ টাকা নিয়ে বিয়ে করতে গেছি)! এখন আমাকে টাকা যোগাড় করতে হবে। আমি পড়লাম উভয় সংকটে। একদিকে পরীক্ষা আরেক দিকে বন্ধুর এই বিপদ। ফিরিয়ে দেওয়ার ছেলে আমি না জেনেই ও এসেছে। আম্মাকে বললাম আমার এক বন্ধুর বাবার হার্ট এটাক হয়েছে আমাকে এখনই ওর সাথে যেতে হবে আর কিছু টাকাও লাগবে। আরও বললাম ও গ্রামের ছেলে এখানে কেউ নেই তাই আমার সাহায্য লাগবে। দিপুকে আম্মা চেনে তাই ওর কথা বললাম না। আম্মা বলল পরীক্ষার কি হবে? বললাম এটা ক্লাস টেস্ট, সাপ্লিমেন্টারি দিতে পারব স্যারকে বলে। আমার মমতাময়ী মা আর কিছু না বলে আমার হাতে পাঁচশত টাকা দিয়ে বললেন আমার কাছে এই আছে এখন। যদি লাগে পরে এসে নিয়ে যাস। তখন পাঁচশত টাকার মূল্য ছিল। পরীক্ষা বাদ দিয়ে আমি চললাম বন্ধুর বিয়ের ব্যবস্থা করতে।

দিপু জানালো আমাদের অন্যতম আড্ডা-স্থল জহুরুল হক হলের সামনে হারুনের দোকানে মিতুকে রেখে এসেছে। ওখানে এসে দেখি বন্ধুরা কেউ নেই, এই সময়ে সাধারণত কেউ থাকেনা। ক্লাসের পর রাত দশটা এগারোটা পর্যন্ত এবং ছুটির দিনে সকাল থেকে এই আড্ডা থাকে সরগরম। এফ রহমান হলে যেয়ে বন্ধু মানুকে খুঁজলাম, পেলামনা। তখন দিপু বলল চল পার্থকে নিয়ে যাই। পার্থ ছিল প্রখ্যাত রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী ও বাংলার অধ্যাপক সানজিদা খালার ছেলে। ওরা থাকতো আমাদের পাশের বিল্ডিং উনত্রিশ নম্বরে। দিপু যেয়ে ওকে নিয়ে আসল। মিতু এক কাপড়ে বেড়িয়ে এসেছে নইলে সন্দেহ করত।

আমরা সোয়ারী ঘাটে রিকশায় এসে নদী পার হলাম। এরপর কিছুটা বাসে ও হাঁটা পথে। ক্ষেতের আল ধরে, উঁচুনিচু ধান ক্ষেতের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে মিতু দাঁত কিড়মিড় করে বলতে লাগল দিপু আমারে কই নিয়া যাইতাছে। আবার বলে বিয়ের শাড়ী কেনার টাকাও নাই। আমি কিছু না বলে ভাবছিলাম ওদের কথা। এক বিয়ের হলুদে প্রথম দিপু মিতুকে দেখিয়ে বলেছিল মেয়েটা কেমন। খুব সুন্দর গান গায়। বললাম দেখতে তো ভালোই, তবে কথা না বললে বুঝব কেমন করে আসলে কেমন! ডাকো ওকে। বলল এখনও কিছু হয় নাই, তবে হবে। আরেক বন্ধু বলল আরে রাখো ও তোমারে পাত্তাই দিবনা। দিপু বলল বাজী ধরো এক মাসের মধ্যেই আমি ওর সাথে প্রেম করবো এবং আমাদের আড্ডায় নিয়ে আসবো। আমি জানতাম ও তা পারবে। ঠিকই কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই দিপু মিতুকে নিয়ে আসে আমাদের আড্ডায় এবং ঘোষণা দেয় তার সাফল্যের। বলে যে যত খুশী খাও সব বিল আমি দিব। সবাই বলল এই বিলটা দিবে যে বাজী ধরেছে সে, কারণ ওর হার হয়েছে। দিপু বলল তাহলে আমি! বললাম ধীরে বন্ধু, তোমাকে একটু বেশীই খসাবো শুধু চা, সিগারেট ও শিঙ্গাড়ায় হবেনা। মিতুও কিছুদিনের মধ্যে আমাদের সাথে মিশে যায়। মাঝে মাঝেই মিনি, মিতু এসে আমাদের সেই ফুটপাতের আড্ডায় যোগ দিত। মিতু সবসময়ই শাড়ী পড়ত সেই বয়স থেকেই আর খেত পান। যা সেই সময়ে শহুরে মেয়েদের মধ্যে কমই ছিল। আর বরিশালের ভাষায় মাঝে মাঝে ঝাড়ি দিত যে রাম দা দিয়া কোপাবে বলে। আমার নীরবতা দেখে বলে ভয় পেয়েছেন, আপনি না আমার ভাই। তাড়াতাড়ি বললাম আরে না ভাবছি কি ভাবে কি করা যায়। এইটুকু জীবনে অনেক দুরন্তপনাই করেছি এই কাজটি ছাড়া। ও হাসতে হাসতে বলল ভালোই হল এই অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে কাজে লাগতে পারে।

কেরানীগঞ্জে তখনও ছিল গ্রামীণ আবহ। ঢাকার এতো কাছে বলে দিপুর খুব যাওয়া আসা ছিল। আমিও আগে এসেছি ওর সাথে। ওখানেও ওর অনেক বন্ধু ছিল। আর ছিল চাচাত ভাই টিপু দাদা। পৌঁছেই শুরু হয়ে গেলো ওর হাঁকডাক। একজন ছিল মহাদেব, ওদের ছিল দুধ ও মিষ্টির কারবার। তবে মহাদেব কলেজের অধ্যাপক ও বুলবুল একাডেমীর গানের শিক্ষক হয়েছিল। ও নিজেও ভালো গাইত। বাসার তালা খুলে মিতুকে বসিয়ে দিপু হাওয়া। কারণ ও তখন বিয়ে করার ফুর্তিতে ঘুরে ঘুরে সবাইকে খবর দিচ্ছে। মিতু রেগে গিয়ে বলল আকাশ ভাই ওকে ধরে নিয়া আসেন তো। বললাম শোন বিয়ের কনে এখানে চুপ করে বসে থাকো বিয়ের আগে আর দেখাদেখি নাই। ও বলল আপনি তো কাঠ মোল্লা হয়ে গেছেন! বললাম আরে না, তাকিয়ে দেখো এর মধ্যেই দিপুর লাফালাফিতে কত মহিলা ও মেয়েরা এসে গেছে তোমাকে দেখতে, তাদের সাথে গল্প কর। এর মধ্যে টিপু দাদা ও মহাদেব এসে আমাকে ডাকল। টিপু দাদা বলল আকাশ তুমি আর মহাদেব কাজীর বাড়িতে গিয়ে তাঁকে নিয়ে আসো। আমার যাওয়াটা ঠিক হবেনা। বাড়ীতে গিয়ে দেখি কাজী গেছে ক্ষেতে চাষ করতে। কোন ক্ষেতে জেনে নিয়ে আমরা গেলাম সেখানে। কাজী সাহেব তখন খালি গায়ে, লুঙ্গি কাছা মেরে ক্ষেতে চাষ করছেন। আমাদের দেখে গরু থামিয়ে কি ব্যাপার জানতে চাইলেন। বলার পর আমাদের কথা উড়িয়ে দিয়ে বললেন সন্ধ্যার আগে হবেনা, তার কাজটা আজকে শেষ করতেই হবে। আমাদের কোন অনুরোধই শুনলেন না। মহাদেব আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপল, বুঝলাম এখন একটাই পথ। মহাদেব ছিল লম্বা চওড়া এক যুবক। সাথে সাথে কাজীকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিল। আমি অন্য চাষিদের যেয়ে বললাম তার গরুদের দেখতে। উনি চেঁচামেচি করতে লাগলেন। বললাম চুপ করেন, না হলে আছাড় মারলে হারগোর ভেঙ্গে যাবে। তখন নরম হয়ে বললেন আমার রেজিস্ট্রি বই, লুঙ্গি, পাঞ্জাবী, টুপি আনতে হবে। মহাদেব আমাকে বলল তুমি উনার বাসায় যেয়ে সব নিয়ে আসো, ওকে ছাড়লে যদি ভাইগা যায় তাইলে সব গড়বড় হইয়া যাইব। কাজী সাহেবের বাসায় যেয়ে তার স্ত্রীকে বললাম কাজী সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন সব কিছু নিয়ে যেতে। ভদ্রমহিলা আমার দিকে সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন সত্যিই পাঠাইছেন, উনি তো এখন ক্ষেতে কাজ করার কথা! বললাম ঘণ্টা দুয়েকের ব্যাপার, ঢাকা থেকে একজন ভি আই পি এসেছেন দিপুদের বাসায়, তার মেয়ের বিয়ে, কারণ ছেলে রাতেই আমেরিকা চলে যাচ্ছে। উনি আমার কথায় সন্তুষ্ট হলেন ও মুখে হাসি ফুটে উঠল, বলল মিষ্টি ও পান পাই যেন। বললাম অবশ্যই দিয়ে যাব।

ফিরে আসতেই দিপুর বড় চাচী আমাকে, পার্থকে ও টিপু দাদাকে ডেকে নিয়ে গেল। বলল কাজটা কি ঠিক হইতাছে এইভাবে বিয়া পড়ানো! দিপু তো একটা পাগলা সাথে তোমরাও নাচতাছো, পরে আমি কি জওয়াব দিমু ওর মার কাছে। বললাম চাচী আপনারা মুরুব্বীরা ধারে কাছেও আইসেন না। এ ছাড়া আর কোন উপায় নাই। দিপু চাকুরী করে, বউরে খাওয়াইতে পারবো। এরপর মহাদেবকে বললাম একটা শাড়ী কিনতে হবে। আমার কাছে তো বেশী টাকা নেই তাই তাঁতের হলেই চলবে। আমি জানতাম মিতু সবসময় সুতির শাড়ীই পড়ে। ওকে নিয়ে দোকানীর বাড়িতে গিয়ে কিনে আনলাম। এরপর মহাসমারোহে কাজী সাহেব বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন।

আর ভাই হিসাবে আমিই হলাম মেয়ের অভিভাবক। মহাদেব ওদের বানানো গরম গরম ইয়া বড় বড় রসগোল্লা আর দই নিয়ে হাজির। সবাই মিলে মহানন্দে খেলাম। শুরু হয়ে গেল উৎসব। সব শেষ হতে বিকাল গড়িয়ে গেল। কিছুদিন আগেই টিপু দাদার বিয়ে হয়েছে। তখনও বাসর ঘর সাজানোই ছিল। ঠিক হল ওখানেই হবে দিপু-মিতুর বাসর রাত। আর সন্ধ্যায় মিতু, মহাদেব ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে বসবে গানের আসর। কিন্তু আমার সেখানে থাকা হবেনা।

দিপু আর মিতু মিলে আমার উপর আরেক গুরু দায়িত্ব অর্পণ করল। সেটা হল ওদের দুজনের বাসায় আমাকে বিয়ের সংবাদটা জানাতে হবে। মিতুদের বাসায় জানাতে হবে ফোনে, না হলে ওর মা তুলকালাম কাণ্ড করবে। আর দিপুদের বাসায় যেহেতু আমার অবাধ যাতায়াত, তাই সেখানে যেয়ে বুঝিয়ে ওদেরকে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে।

ঢাকায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা। বাসায় যেয়ে আম্মার সাথে দেখা করে আসলাম। আম্মা উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলেন বন্ধুর বাবা কেমন আছেন। টিএসসি থেকে ফোন করলাম মিতুদের বাসায়। আমাদের বাসা থেকে ফোন করলাম না, যদি ফোন ট্র্যাক করে (থ্রিলার পড়ে অর ছবি দেখে আমরা তখন একেকজন একশন হিরো)। খবরটা জানাতেই মিতুর মা ধমক দিয়ে বললেন ওরা কোথায় আছে জানাতে, উনি পুলিশ পাঠিয়ে ওদেরকে ধরে নিয়ে আসবেন সাথে আমাকেও। বললাম বাহ আপনি পুলিশে দিবেন আর আমি ঠিকানা দিব, কি অদ্ভুত কথা! এক পর্যায়ে আমিও রেগে গেলাম এবং বাংলা সিনেমার সংলাপের ভঙ্গীতে বললাম “মোটেও সেই চেষ্টা করবেন না। এর পরিণতি ভালো হবেনা” (শুধু হা… হা… হা… টা উচ্চারণ করলাম না)। উনি আরও উত্তেজিত হয়ে গেলেন এবং আমাকে শাসাতে লাগলেন। আমি ফোন ছেড়ে দিলাম।

দিপুদের বাসায় যখন পৌঁছলাম তখন ঘড়ির কাঁটা রাত আটটার ঘরে। বেল বাজাতেই দিপুর ছোট ভাই দরজা খুলল। ও ছিল তখন আর্ট কলেজের ছাত্র (এখন অধ্যাপক ও চিত্রকর) আর স্বভাবে দিপুর বিপরীত । ওকেই প্রথম খবরটা দিলাম। ও শুধু বলল দিপু’দা দাদা-বাড়ীতে যেয়ে এটা না করলেই পারতো। তারপর বলল বাবুকে (ওরা বাবাকে বাবু ডাকে) নিয়ে আসছি আপনিই সব বলেন। চাচা এলেন। উনিও ছয় ফিটের উপর লম্বা, শুভ্র বাবরি চুল ও গুন্টার গ্রাসের মত লম্বা গোঁফ, যেন এক ঋষি। আর স্বভাবে উচ্চস্বরে কথা বলা, হৈ চৈ করা উচ্ছল আনন্দময় একজন মানুষ। বসেই চিৎকার করে বললেন আকাশকে চা দাও। তারপর বললেন দিপু কই। বললাম আমি ওর কাছ থেকেই আসছি, কথা আছে আপনার সাথে। বললেন বল আবার কি ভ্যাজাল লাগাইছে ও। সব খুলে বললাম। শুনেই খুশীতে সোফা থেকে লাফিয়ে উঠে বললেন বিয়ে করেছে , খুব ভালো কথা, আনন্দের কথা। আবার হাঁক দিলেন শুনো দিপুর মা তোমার ছেলে তো বিয়ে করে ফেলেছে, এই যে আকাশ খবর নিয়ে এসেছে। তারপর আমাকে বললেন তা “নাটের গুরু” এখন বাকী কাজটুকুও যে তোমাকেই করতে হবে। সুবোধ বালকের মতন বললাম আপনি যা বলবেন তাই করব চাচা। উনি ঠাট্টা করে বললেন যা করার সব তো করেই ফেলেছো। আমি যাচ্ছিনা, তুমি ওয়াহিদুল আর লালকে সাথে নিয়ে যেয়ে ওদেরকে বাসায় নিয়ে আসো। তারপর ফোন করলেন ওনার দুই বন্ধুকে। আমাকে বললেন কাল সকালে ওরা সানজিদার বাসায় থাকবে, ওদের সাথে ওখানে দেখা করবে। পার্থর বাবা ওয়াহিদুল হক চাচা, সানজিদা খালা ও দিপুর বাবা পুরানো বন্ধু এবং একসাথেই “ছায়ানট” প্রতিষ্ঠা করেছেন, রবীন্দ্র আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন।

পরদিন সকাল দশটায় সানজিদা খালার বাসায় বেল বাজাতেই উনি দরজা খুলে দিলেন। হাসিমুখে বললেন তুমিই আকাশ, মান্নান সাহেবের যে এমন সুন্দর একটা ছেলে আছে আমি তো জানতামই না! আমি কিঞ্চিৎ লজ্জা পেলাম। ওয়াহিদ চাচা, লাল চাচা এবং বন্ধু মঞ্জুকে নিয়ে রওনা হলাম। লাল চাচা চিরকুমার এবং একজন কমিউনিস্ট নেতা। মেধাবী মঞ্জু ইকনমিকসের ছাত্র কিন্তু বোহেমিয়ান স্বভাবের, পড়াশোনা বাদ দিয়ে ঘুরে বেড়ায়। আর ওয়াহিদুল হক চাচা তো নানা গুনে গুণান্বিত এক অসাধারণ মানুষ। উনার বাড়ীও কেরানীগঞ্জ, তাই সেখানকার সব তার চেনা। ঘাটে যেয়ে নৌকা ভাড়া করলেন অপুদের বাড়ির পেছনে খাল পর্যন্ত। নৌকায় উঠে প্রথমে গুনগুনিয়ে পরে দরাজ গলায় গান ধরলেন। উনি যে এত সুন্দর গান করেন আমার জানা ছিলনা। একসময় বললেন আকাশ গান ধরো। বললাম চাচা আমি তো গাইতে পারিনা। বললেন আমি যে শুনলাম তুমি গীটার বাজাও। বললাম গাইতে পারিনা দেখে বাজানোও ছেড়ে দিয়েছি। উনি আধো শোয়া থেকে উঠে বসলেন, বললেন ছায়ানটে আসো গান শিখতে। তোমার বাড়ীর পাশে গানের স্কুল সবাই যায় আর তুমি যাবানা! আসলেই তাই আমার ভাইবোন ও আমাদের ঈসাখান রোড, ফুলার রোডসহ আশেপাশের মোটামুটি সব বয়সের ছেলেমেয়েরা নাচ, গান, তবলা, সেতার কিছুনা কিছু শিখত। অনেকে গান গেয়ে নামও করেছে। কিন্তু ততদিনে আমার জীবনের “প্রাইয়রিটি” বদলে গেছে। চাচা বললেন তোমার বাবাও আমাদের বন্ধু।

দিপু-মিতুকে নিয়ে আমরা ফিরে এলাম দিপুদের বাসায়। দুজনেই মহা-খুশী ও আনন্দ জোয়ারে ভাসছে। একদিকে বন্ধুরা সবাই মিলে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছি। আরেকদিকে দিপুর বাবা যোগাযোগ করছেন মিতুদের বাসায়, বললেন যা হওয়ার হয়েছে এখন উনি চান আনুষ্ঠানিক ভাবে বধূ বরণ করতে তার বাবা মায়ের উপস্থিতিতে। উনারা চাচাকে বাসায় প্রস্তাব নিয়ে আসতে বলেছেন। চাচা বললেন তুমি তো মিতুদের বাসা চেনো আমাকে নিয়ে চল সেখানে। বললাম আমি কিন্তু ভিতরে যাবনা, বাইরে থাকব। বিশ্বাস নাই মিতুর মা আমাকে ধরে চড়-থাপড় লাগাইতে পারে। চাচা অট্টহাসি দিয়ে বললেন সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেয়া যায়না। ওদের বাসা ছিল অগ্রণী স্কুলের উল্টো দিকে আজিমপুর কলোনিতে। আজিমপুর কলোনি এলাকা ছিল আমার আরেক আড্ডা-স্থল। সেখানে ছিল ছোট ভাই, বড় ভাই এবং অসংখ্য জিগিরি দোস্ত। এমন কি মিতুর খালাত ভাই নাসেরও।

ছুটির দিনে গেলাম, চাচা ওদের বাসায় ঢুকলেন। আমি যেয়ে আজিমপুর কমিউনিটি সেন্টারে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিচ্ছি আর একটু পর পর এসে দেখছি উনি বেরুলেন কিনা। ঘণ্টা দেড়েক পরে বের হয়ে আসলেন। জানালেন সব ঠিক আছে, তবে ওরা দুটো শর্ত দিয়েছিল। এক, বিয়ের কাবিননামা তাদের হাতে দিতে হবে উনারা তা ছিঁড়ে ফেলবেন এবং বিয়ে যে হয়েছে তা জানানো যাবেনা। আমি মেনে নিয়েছি, তবে দ্বিতীয়টা মানতে পারিনি। জিজ্ঞেস করলাম কেন? উনি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললেন তা হল তোমাকে ওর মায়ের কাছে পাঠাতে হবে। তুমি নাকি তাঁকে হুমকি দিয়েছো, আমি বলেছি এটাই তো তারুণ্যের ধর্ম ওরা কিছুই মানেনা, পরওয়া করেনা, না ভেবে আবেগের বশে অনেক কিছুই বলে ফেলে। তাছাড়া ও খুব ভালো ছেলে। তোমার বাবার কথা বলার পর থেমেছেন। তোমার বাবাকে ওর বাবা খুব ভালো চেনেন ও জানেন। তারপর চাচা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন বুঝলা আকাশ এমনই হয়, বিয়ে করলো তার মেয়ে আর আমার ছেলে কিন্তু সব রাগ এখন তোমার উপর!

এরপর চলতে লাগল বিয়ের প্রস্তুতি। মিনিও প্রতিদিন আসছে ও সব কিছুতেই সহযোগিতা করছে। চাচা বললেন এই মেয়েটা কে, বললাম আমার বন্ধু ও একসাথে পড়ি। গোঁফের আড়ালে হেসে বললেন বুঝেছি। তবে পড়াশোনা শেষ না করে দিপুর মত কিছু করে বসোনা আবার!

হলুদের দিন দিপুদের বাসায় আলপনা আঁকছেন দিপুর বাবার বন্ধু সব বিখ্যাত চিত্রকরেরা, কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, রশিদ উদ্দিন, আব্দুল বাসেদ, আব্দুর রাজ্জাক, হাশেম খান, আলভী আরও অনেক গুণীজন। পালা করে একেক জন তুলির আঁচড় দিচ্ছেন আর ফুটিয়ে তুলছেন অপূর্ব সব আলপনা। বাসায় উপস্থিত আর্ট কলেজের আমাদের বন্ধুরা, ছোট ভাইরা কোন সুযোগই পেলনা। বৌভাতের দিন দলে দলে ছেলেরা আসছে আর্ট কলেজ থেকে, হোস্টেল থেকে, কেরানীগঞ্জ থেকে। কারণ দিপু সেখানে যেয়ে গণ দাওয়াত দিয়ে এসেছে। যারা অন্যের কাছে শুনেছে তারাও আসছে আর বলছে দিপু ভাইয়ের বিয়ের আবার দাওয়াত লাগে নাকি! দুপুর থেকে রাত পর্যন্ত চলল ভোজন পর্ব।

এত আনন্দের মধ্যে মিতুর মা এসে আমাকে এক সময় ঠিকই পাকড়াও করলেন। আমি চারিদিকে তাকিয়ে বিশ্বাসঘাতকটাকে খুঁজতে লাগলাম যে আমাকে দেখিয়ে দিয়েছে। উনি কোমরে হাত দিয়ে, আঁচল পেঁচিয়ে সামনে দাঁড়ালেন। আমার তো আত্মারাম খাঁচাছাড়া, পালাতে পারলে বাঁচি। উনি আমার মতলব টের পেয়ে হাত ধরে বললেন এসো আমার সাথে। একটু নিরিবিলিতে গিয়ে দাঁড়ালেন, ভাবলাম এখনই বুঝি আমার গালের উপর চটাস করে এসে পরবে উনার সব রাগ। দেখি উনি আমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন এবং সেখানে হাসির ছোঁয়া। বললেন আমি তোমার খোঁজ নিয়েছি আমার বোনের ছেলের কাছে। তোমার ফুপুকে আমি চিনি, আজিমপুরে আরও অনেকেই তোমাকে চেনে। সবাই বলেছে খুব ভালো, পরোপকারী ছেলে। তাই আমার রাগটাও পড়ে গেছে। আমি বললাম তাহলে বুঝতেই পারছেন খালাম্মা বন্ধুর উপকারার্থেই আমি এই কর্মে সহযোগী হয়েছি। বললেন আমিতো তোমাকে আগে দেখিনি এখন দেখলাম। ভাবছি তোমার মতন মিষ্টি চেহারার একটা ছেলে কি করে এমন কঠিন কণ্ঠে হুমকি দিতে পারে! বললাম মাফ করবেন, ভুল হয়ে গেছে। আমরা আসলে খারাপ না। কিন্তু যখন উত্তেজনার মধ্যে থাকি তখন ভুলভাল অনেক কথা ও কাজ করে ফেলি। উনার প্রসন্ন মুখে হাসি দেখে বুঝলাম আমি ক্ষমা পেয়ে গেছি। বললেন উপকার করতে গেলেও বুঝ-শুনে করতে হয়। কেউ বললেই ঝাঁপিয়ে পড়োনা। মুখে বললাম তথাস্তু, কিন্তু বাস্তবে তা পালন করতে পারিনি।

অতঃপর তাহারা সুখে শান্তিতে সংসার করিতে লাগিল....................................।

আমার কথাটি ফুরালো নটে গাছটি মুড়ালো। আসলেই কি ফুরালো! জীবন অনেক দীর্ঘ, এর প্রতি পদে পদে বিস্ময় আর রহস্যময়তা। প্রেম-ভালোবাসার সম্পর্ক আরও বেশী দুর্বোধ্য ও রহস্যময়। কখনও তা পূর্ণিমার রাতে ঝরে পড়া জোছনার মত সুন্দর, কখনও বা আমাবস্যার নিকষ কালো অন্ধকারে ঢাকা। ভালোবাসারা হেঁটে যায় ভোরের শিশির ভেজা শিউলি ছড়ানো সুবাসিত মসৃণ পথে। আবার সে-ই রক্ত ঝরায় যখন পথ হয়ে উঠে দুর্গম ও কণ্টকিত। জীবনের মৃত্যু নেই, বেঁচে থাকে পুরানো আলো সরে গিয়ে নতুন কোন আলোয়। ভালোবাসারও মৃত্যু নেই, বিচ্ছেদেও তারা বেঁচে থাকে অনন্তকাল। তাই জীবনের গল্প, ভালোবাসার গল্প কখনো শেষ হয়না। আমার গল্পেরও শেষ নেই! এইসব আনন্দ-বেদনা নিয়েই বয়ে চলে ভালোবাসাময় কিংবা ভালোবাসাহীন আমাদের এই জীবন। এভাবেই আমরা বেঁচে আছি, বেঁচে থাকি!




কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি






Share on Facebook               Home Page             Published on: 19-Feb-2022

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far