সেই সময় ও হিমালয় দর্শন কামরুল মান্নান আকাশ
আগের অংশ
আমি ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলাম না কিন্তু রাজনীতি করা কিছু মানুষের সাথে ছিল আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি রেজাউনুর রহমান বাবুল ভাই (ভি পি বাবুল) ছিলেন বড় ভাইয়ের মত, খুব কাছের মানুষ। উনি আমাকে প্রায়ই নিয়ে যেতে চাইতেন ছাত্রলীগ অফিসে। বলতেন তোকে কেউ পার্টি করতে বলছেনা, আমার সাথে শুধু চল একদিন। ঢাকা কলেজের উল্টা দিকেই ছিল তখন ছাত্রলীগের অফিস (পরে এটা জনতা ব্যাংক হয়েছিল)। একতলায় মহানগর আর উপর তলায় কেন্দ্রীয় কার্যালয়। তো গেলাম একদিন নগর ছাত্রলীগ অফিসে। পরিচয় হল সভাপতি সৈয়দ নুরুল ইসলাম নূরু ভাই, ডাবলু ভাই, রউফ ভাই, ইউনুস ভাই, পিন্টু ভাই, শামিম ভাই সহ আরও অনেকের সাথেই। প্রথম দেখাতেই সাদাসিধা নূরু ভাইকে ভাল লাগল। তিনি কর্মীদের জ্ঞান বৃদ্ধির জন্য বই পড়তে বলছেন এবং বিভিন্ন রকমের প্রশ্ন করছেন। তাঁদের জ্ঞানের স্তর খুব একটা উন্নত ছিলনা তাতে নূরু ভাই অসন্তোষ প্রকাশ করছিলেন। পরেও দেখেছি বামপন্থি সংগঠনগুলো ছাড়া অন্য সংগঠনগুলোতে জ্ঞান চর্চার অভাব ও অনাগ্রহ। অনেক সাধারণ প্রশ্নের উত্তরও কেউ পারছিলনা। একসময় যখন জিজ্ঞাস করলেন ক্রুপস্কয়া কে ছিলেন, আমি আর থাকতে না পেরে বলে উঠলাম লেনিনের স্ত্রী। নূরু ভাই চমৎকৃত হলেন, বললেন তুই কি আগের গুলার উত্তরও জানিস, আমি লজ্জিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালাম। এরপর ডেকে নিয়ে তার পাশে বসালেন আর বললেন এখন থেকে সামনে বসবি। সংগঠনের কেউ না হয়েও আমি হয়ে গেলাম তার প্রিয় পাত্র এবং সেই টানেই সেখানে যাওয়া শুরু করলাম। একদিন গিয়ে শুনলাম উনারা যাচ্ছেন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করতে। আমাকেও যেতে বললেন, আমি বললাম আমিতো সংগঠনের কেউ না। নুরু ভাই বললেন তুই আমার ছোট ভাই সেই পরিচয়ই যথেষ্ট। আমারও খুব লোভ হল এই বিশাল মানুষটিকে এত কাছ থেকে দেখার, তাই চললাম উনাদের সাথে। ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বর এই বাড়িটির পাশ দিয়ে অনেকবার গিয়েছি কিন্তু কখনো ভিতরে ঢোকার সুযোগ হয়নি। তাই আজ উত্তেজিত। বাড়িতে প্রচুর মানুষের জটলা। গ্রাম থেকে আসা খুব সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে নেতা কর্মীরাও সাক্ষাত প্রার্থী, মনে হল কাউকেই নিরাশ করা হচ্ছেনা। কিছুক্ষণ পর ডাক পড়ল আমাদের। নুরু ভাই তো বটেই আরও অনেককে দেখলাম বঙ্গবন্ধু নাম ধরে ডাকছেন। শুনেছি উনি নাকি একবার কাউকে দেখলে আজীবন তাকে নামসহ মনে রাখতে পারতেন। আমার দিকে তাকাতেই নুরু ভাই বললেন আমার ছোট ভাই আপনাকে দেখতে এসেছে। মনে হল এরকম অনেকেই উনাকে দেখতে আসে এবং তাতে উনি অভ্যস্ত। স্মিত হেসে পিঠে হাত রাখলেন। তাতেই আমি বর্তে গেলাম। মনে হল আমার হিমালয় দেখা হয়ে গেল। বাইরে বেরিয়ে এসেও আমি যেন একটা ঘোরের মধ্যে থেকে গেলাম। ফিদেল কাস্ত্রো বঙ্গবন্ধুকে দেখে তাঁকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন “আমি হিমালয়কে দেখিনি, কিন্তু শেখ মুজিবকে দেখেছি!” সেই হিমালয়ের এত কাছে এসে আমি শিহরিত। দূর থেকে বা কাছ থেকে সেটাই শেষ দেখা।
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসব আর তাতে যোগ দিতে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। কলাভবনসহ আরো কয়েকটি ভবন ও হল পরিদর্শন করে সমাবর্তনে যোগ দেবেন। ১৪ আগস্ট ঘুরে ঘুরে দেখছি তার প্রস্তুতি। চারিদিকে প্রাণ চাঞ্চল্য আর কর্মব্যস্ততা। নতুন সাজে সাজছে ক্যাম্পাস। সোশিওলজি ডিপার্টমেন্টের সামনে দেখলাম শেখ কামালকে।
পনের তারিখ সকালে যখন ঘুম থেকে উঠেছি তখনো সবাই ঘুমিয়ে শুধু মাত্র আব্বা তার প্রতিদিনকার প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন। আব্বা এবং অন্য শিক্ষকেরা হাঁটতে যেতেন সোহরাওয়ার্দি উদ্যান হয়ে রমনা পার্কে, আমরাও মাঝ মাঝে যেতাম। সারাদিন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ঠাসা আজকের দিনটিতে কি কি করব তাই ভাবছিলাম। দরজায় কে যেন ঘন ঘন বেল বাজাচ্ছে তাই উঠে এলাম দরজা খুলতে। তাড়াহুড়ো করে আব্বা এসে ঘরে ঢুকলেন। বললেন রাস্তায় কাল পোশাক পরা সেনাবিহিনির লোকজনকে টহল দিতে দেখেছেন এবং পুলিশ কন্ট্রোল রুম ও রেডিও অফিসের সামনে ট্যাংকও রয়েছে। সবাই বলাবলি করছে ওরা নাকি শেখ মুজিবকে মেরে ফেলেছে। আব্বা তাড়াতাড়ি রেডিওটা অন করলেন আমরা সবাই সেখানে যেয়ে বসলাম। আর অমনি ইথারে ভেসে এলো মেজর ডালিমের সেই উদ্ধত ঘোষণা। এরপর খন্দকার মোশতাক আহমদের ভাষণ। দেশে সামরিক আইন জারী করা হয়েছে এবং সে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। সবশেষে বলা হল “বাংলাদেশ জিন্দাবাদ”। বিষণ্ণ কণ্ঠে আব্বা বললেন একি করল ওরা, জিন্দাবাদ শুনে মনে হচ্ছে পাকিস্তানপন্থীরা এর পিছেন আছে। কেমন যেন একধরনের শূন্যতা ছড়িয়ে পড়ল। ভাবতেও অবাক লাগছিল পাকিস্তানীরা যা করতে সাহস করেনি এই দেশেরই পথভ্রষ্ট কিছু লোক অনায়াসে তা করে ফেলল! আরও খবর জানার জন্যে বাসা থেকে বের হলাম। আম্মা বলে দিলেন পাড়ার বাইরে যেন না যাই। আমাদের পাড়ার (ঈসাখান রোড) গেটের সামনে এসে দাঁড়ালাম। রাস্তায় লোকজন কম হলেও কেমন যেন সব স্বাভাবিক, মনে হয় অনেকে কি ঘটে গেছে তা জানেওনা। ফুলার রোড এবং আমাদের পাড়ার গেটে জটলা। জানতে পারলাম কিছুক্ষণ আগে মেজর ডালিম আর কর্নেল ফারুক এসেছিলেন অধ্যাপক রাজ্জাক সাহেবের বাসায়। ডালিম নাকি তার ভাতিজা হয় সম্পর্কে। জাতীয় অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক ছিলেন বঙ্গবন্ধুর শিক্ষক, যাকে উনি পায়ে ধরে সালাম করতেন (অল্প দাড়ির কারণে আড়ালে ওনাকে আমরা হোচিমিন দাদু বলে ডাকতাম)। পরে সেই সাক্ষাতের আরও কথা জানতে পারি। দেশের রাজনীতি-অর্থনীতি নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল কর্নেল ফারুক। রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন “ছাত্ররা পয়সা খরচ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে তার সঙ্গে এসব বিষয়ে আলোচনা করে। তিনি কেন শুধু শুধু বাইরের একজনের সাথে তা নিয়ে আলাপ করবেন। খুব বেশী জ্ঞান পিপাসা থাকলে নিউমার্কেট থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির নোটবই কিনে যেন পড়াশুনা করে (বিপুলা পৃথিবী-অধ্যাপক আনিসুজ্জামান)”।
রেডিওর মাধ্যমে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান, পুলিশ, বি ডি আর, রক্ষীবাহিনী সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করল কিংবা করতে বাধ্য হলো। মন্ত্রীসভা গঠিত হলো আগের মন্ত্রী প্রতি মন্ত্রীদের নিয়েই, শুধু থাকলেন না কিছু সিনিয়র মন্ত্রী ও নেতারা। পরদিন অর্থাৎ ১৬ই আগস্ট হেলিকপ্টারে করে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যাওয়া হয় টুঙ্গিপাড়ায় এবং সেখানেই অতি দ্রুততার সাথে দাফন করা হয়। নিজ গ্রামেই সমাধিস্থ হয়ে রইলেন বাঙালী জাতীয়তার জনক, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিশ্ব ও মানবসভ্যতার ইতিহাসে ঘৃণ্য ও নৃশংসতম এই হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে সেদিন তারা কেবল বঙ্গবন্ধুকেই নয়, স্বাধীনতার আদর্শগুলোকেও হত্যা করতে চেয়েছিল।
একদিন রাতের অন্ধকারে বাবুল ভাই আসলেন বললেন উনি নুরু ভাইয়ের সাথে টাঙ্গাইল হয়ে ইন্ডিয়া চলে যাচ্ছেন সাথে শামীম ভাই, পিন্টু ভাই আরও অনেকে। ওখান থেকে এসে যুদ্ধ করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নেবেন। ওনাদের সবার বাড়িই ছিল টাঙ্গাইল। এরপর আর তাঁদের কারোও কোন খবর পাইনি। শুনতাম ময়মনসিংহ সীমান্তে কাদের সিদ্দিকির নেতৃত্ব লড়াই হচ্ছে। ১৯৭৭ সাল হবে হঠাৎ করে একদিন দেখা হল শামিম ভাইয়ের সাথে (সেই শামীম মোহাম্মদ আফজাল এখন বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের এবং ইসলামি ব্যাঙ্কের পরিচালক) বললেন বাবুল ভাই মারা গেছে আর নুরু ভাইকে জবাই করে হত্যা করা হয়েছে কাদের সিদ্দিকির সাথে দ্বন্দ্বের কারণে। উনি আর পিন্টুভাই জেল খেটেছেন অনেকদিন। নূরু ভাই, বাবুল ভাই এমনি ভাবে প্রাণ দিলেন তার নেতার হত্যার প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে। আর তাদের নেতা জীবন দিয়ে গেছেন দেশ আর দেশের মানুষকে ভালবেসে।
ডেভিড ফ্রস্ট যখন বঙ্গবন্ধুকে নিজের ‘কোয়ালিফিকেশন’সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে, তখন তিনি বলেছিলেন, ‘আই লাভ মাই পিপল। ‘ডিসকোয়ালিফিকেশন’ জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আই লাভ দেম টু মাচ। সত্যিকার অর্থে তিনি বাংলার মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। আওয়ামীলীগের শাসনকাল নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে কিন্তু তাই বলে স্বাধীনতার জন্য যুগ যুগ ধরে তাঁর লড়াই ও আত্মত্যাগ মিথ্যা হয়ে যাবেনা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই নামটি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের সাথে। মানচিত্রের সাথে। অস্তিত্বের সাথে।
আগের অংশ
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি
|