সেই সময় ও হিমালয় দর্শন কামরুল মান্নান আকাশ
পনেরই আগস্ট ছিল বাংলাদেশের স্থপতি, স্বাধীনতা আন্দোলনের পুরোধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যু দিন। বড় বড় মানুষ যারা উনাকে কাছ থেকে দেখেছেন তারাই তাকে নিয়ে, তার শাসনকাল নিয়ে লিখবেন, বলবেন এটাই রীতি। কিন্তু শোধান মানুষ যারা তাঁকে দূর থেকে কিংবা ক্ষণিকের তরে কাছ থেকে দেখেছে এবং সেই সময়কে দেখেছে তাঁদের ভাবনার প্রকাশের জন্যই এই লেখার অবতারণা। আমিও যে সেই সাধারণেরই একজন। রাজনীতিকে স্পর্শ না করে আমি সেই সময়কে এবং সেই সময়ের কিছু ঘটনার কথা মনে করছি। যদিও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে রাজনীতি এবং সময় থেকে আলাদা করা কঠিন। মনে পড়ছে প্রথম এবং শেষ যেদিন বঙ্গবন্ধুকে দেখি সেদিনের কথা। জীবনের অনেক পথ পাড়ি দিয়ে নানা উত্থান পতন দেখে আমরাও কখন যেন হয়ে গেছি ইতিহাসের অংশ।
উনসত্তরের গন অভ্যুত্থানের সময়টি ছিল আমাদের বয়সী ছেলেদের জন্য এক বিরাট টার্নিং পয়েন্ট। পড়াশোনা, স্কুল, খেলাধুলা এই সবের মাঝখানে এসে যুক্ত হয় কিছু নতুন বিষয়। আমরা পরিচিত হতে থাকি মিটিং, মিছিল, হরতাল, কারফিউ এইসব নতুন শব্দের সাথে। লাঠি চার্জ, গুলি, গ্রেফতার, ১৪৪ ধারা এসব হয়ে উঠে নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার। সারা দেশ জুড়েই চলছিল এই অবস্থা। এর মধ্যে ঢাকা, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা থাকত সবচাইতে সরগরম এবং উত্তপ্ত। আউটার স্টেডিয়াম, বায়তুল মোকাররম এলাকায় রাজনৈতিক দল এবং ছাত্রদের বড় বড় জনসভাগুলি হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন, বটতলা এবং শহিদ মিনারই ছিল সকল আন্দোলনের কেন্দ্র বিন্দু। যে সময়ের কথা বলছি সে সময় আমি ছিলাম নিতান্তই বালক। বাবার শিক্ষকতার সূত্রে আমার জন্ম, বেড়ে উঠা এবং শিক্ষা জীবন এই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করেই। হয়ত এই পরিবেশে বেড়ে উঠার কারণেই খুব কম বয়সেই রাজনৈতিক এবং সামাজিকভাবে সচেতন হয়ে উঠি।
সেই বয়সে ছাত্রদের সাথে আমরাও অনেক মিছিলে গিয়েছি বিভিন্ন রকমের শ্লোগানে গলা মিলিয়েছি। বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান তখন ছিলেন জেলখানায় বন্দী। প্রতিটি মিছিলেই শ্লোগান থাকত ‘জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনব, শেখ মুজিবের কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে”। উনসত্তরের গণআন্দোলনের জোয়ারে সরকার বাধ্য হল মিথ্যা আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সকল অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে। বাইশে ফেব্রুয়ারি জানতে পারলাম জেল থেকে বেরিয়ে শেখ মুজিব বিকেল তিনটার দিকে শহীদ মিনারে আসবেন শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। আমারও খুব ইচ্ছা হতে লাগল শহীদ মিনারে যেতে এবং স্বপ্নের এই নেতাকে দেখতে। সবাই প্রস্তুতি নিচ্ছে সেখানে যাওয়ার। কিন্তু যাকেই বলি সেই বলে অনেক ভিড় হবে ছোটদের ওখানে না যাওয়াই ভাল। খুব রাগ হচ্ছিল এই ভেবে যে আমরা এখন মিছিলে যেতে পারি, টিয়ার গ্যাস ছুড়লে পানিতে ভিজিয়ে নেওয়া রুমাল দিয়ে চোখ মুছে নিজেকে রক্ষা করতে পারি এমন কি লাঠি চার্জ করলে দৌড়ে পালাতেও পারি। তাও নিবে না! যদিও মিছিলে আমাদের দৌড় ছিল ক্যাম্পাসের ভিতরেই সীমাবদ্ধ।
যাই হোক সিদ্ধান্ত নিলাম লুকিয়ে হলেও আমি ওখানে যাব। আজ এত বছর পর মনে করতে পারছিনা আমার সব সময়ের সঙ্গী আমার বড় ভাইও সাথে ছিল কিনা। বিকাল তিনটার আগেই এসে শহীদ মিনারে বসে আছি, ঠিক বেদীর কাছাকাছি যাতে খুব কাছ থেকে এই মহান নায়ককে দেখতে পারি। আস্তে আস্তে ভিড় বাড়ছে। তখনকার শহীদ মিনারটিতে এখনকার মত এত জায়গা ছিলনা এবং পরিসরটি ছিল খুব ছোট। এর মধ্যে দেখলাম একজন রিকসা করে এসে নামলেন গলায় কাগজের মালা। সাথে সাথে কিছু লোক দৌড়ে গেল সেদিকে “জয় সর্বহারা এবং কমরেড মনি সিং জিন্দাবাদ” শ্লোগান দিয়ে। জানলাম উনি কমিউনিস্ট পার্টির নেতা এবং আজই জেল থেকে ছাড়া পেয়েছেন। এই যে এত লোকজন সবাই তাহলে অপেক্ষা করছে সেই মানুষটির জন্য যিনি বাঙালীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামের সিপাহশালার! হঠাৎ শোনা গেল তিনি আসছেন। চারিদিক মুহুর্মুহু শ্লোগানে ফেটে পরল। আমি উপর থেকে তাকিয়ে আছি জীবনের প্রথম সেই মানুষটিকে, সেই নেতাকে দেখব বলে। তিনি গাড়ী থেকে বের হলেন দীর্ঘকায় সুপুরুষ, টক টকে গায়ের রঙ আর চোখ পরল মুখের সেই আঁচিলটি - “শত নির্যাতন সয়ে, ভেঙে সেই অন্ধ কারাগার, দৃপ্ত পায়ে নেতা এলেন মাঝে জনতার”। একের পর এক ফুলের মালা দিচ্ছে সবাই তার গলায় আর শ্লোগান উঠছে “জেলের তালা ভেঙ্গেছি শেখ মুজিবকে এনেছি, তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা”। আমি সম্মোহিত হয়ে তাকিয়ে আছি মানুষটির দিকে। তিনি সিঁড়ি ভেঙ্গে এগিয়ে আসছেন মূল বেদীর দিকে, এগিয়ে আসছেন আমার দিকে!কিন্তু হঠাৎ এত মানুষের চাপে মনে হল আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে আর পারছিনা দাঁড়িয়ে থাকতে। চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। আমি সেই কিংবদন্তির এতই কাছে ছিলাম যে চিৎকার শুনে তিনি আমার দিকে তাকালেন এবং মনে হল বললেন আমাকে তুলে নিতে। সাথে সাথে একজন যার হাতে ছিল ইয়াশিকা বক্স ক্যামেরা (কোন পত্রিকার ফটোগ্রাফার হবেন) আমাকে তুলে নেয়। এরপর মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিলাম আর শুনছিলাম তার কথা। দেশের মানুষের উপর অত্যাচার আর নির্যাতনের কথা বলতে বলতে তিনি কাঁদছেন আর রুমালে চোখ মুছছেন। আমারও কেমন যেন কান্না পেতে লাগল। মনে হচ্ছিল এই মানুষটির জন্য বোধ হয় আমিও অনেক কিছু করতে পারি যে নাকি এক অজানা বালকের কষ্টের দিকেও দৃষ্টিপাত করেন, দেশের মানুষের জন্য কাঁদেন!
এরপরের সব ঘটনা খুব দ্রুত ঘটতে লাগল। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর, জলোচ্ছ্বাস আর ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে উপকূলীয় অঞ্চলে। পরদিন পত্রিকার প্রথম পাতায় কালোর পটভূমিকায় প্রধান শিরনামে খবর ছাপা হল আনুমানিক ১০ লক্ষ মানুষ নিহত। সমস্ত দেশ শোকে মুহ্যমান। বড়রা যখন গলায় গামছা বেঁধে হারমোনিয়াম বাজিয়ে “সাহায্য কর গো পুরবাসী” গান গেয়ে পুরানো কাপড় ও সাহায্য সংগ্রহ করছে, আমরাও তাঁদের সাথে গলা মিলিয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরছি (ক্যাম্পাসের ভিতরে)। ডিসেম্বরে নির্বাচনের ফলাফলে দেশ তোলপাড়। আওয়ামী লীগ একচেটিয়া বিজয়ী। কেন্দ্রে এবার বাঙালি নেতৃত্বে সরকার গঠিত হবে। এতকাল বাঙালি যে স্বপ্ন দেখেছে, এবার সেই স্বপ্ন-পূরণ হতে যাচ্ছে।
দেশের রাজনীতি সংঘাতের দিকে মোড় নিচ্ছে। সবার মনেই সংশয় ছিল পাকিস্তানিরা তাদের ২৪ বছরের প্রভুত্ব জনগণের রায় মেনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ছেড়ে দেবে কিনা। অচিরেই ওদের মনোভাব নির্লজ্জভাবে প্রকাশিত হতে লাগল, বাঙালিও গর্জে উঠল। শুরু হল দেশ জুড়ে অসহযোগ আন্দোলন।
আবার দেখলাম প্রিয় নেতাকে দূর থেকে ৭ই মার্চের সেই বিশাল জনসভায়। যেখানে তিনি ঘোষণার সুরে আবৃত্তি করলেন শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতা, “এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। প্রথম দেখার দিনটিতে যে মানুষটিকে শিশুর মত কাঁদতে দেখেছিলাম তাকেই আবার দেখলাম বজ্রকন্ঠে হুংকার দিতে, শুনলাম তাঁর গর্জন। গণজাগরণের ঢেউ গড়িয়ে চলল স্বাধিকার অর্জনের দিকে।
একাত্তরের পঁচিশে মার্চ নিরস্ত্র মানুষকে হত্যার মাধ্যমে বর্বর পাকিস্তানীরা যে আক্রমণের সূচনা করে তাঁর উপযুক্ত জবাব দেওয়া চলতে থাকে প্রতি আক্রমণের মাধ্যমে। শুরু হল আরেক অধ্যায় – একাত্তরের মুক্তির সংগ্রাম – প্রতিটি মানুষের, পরিবারের এবং সমগ্র দেশের।
মায়ের অশ্রু, বোনের সম্ভ্রম আর লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে নয় মাস রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। কিন্তু এত আনন্দের মাঝেও নেমে আসে শোকের ছায়া। যিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন স্বাধীনতার সেই নেতাই আজ নেই তার স্বাধীন বাংলাদেশে।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে একসময় বাধ্য হয় গণহত্যাকারী পাকিস্তান সরকার আপোষহীন এই নেতাকে মুক্তি দিতে। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসছেন এই সংবাদে আবার খুশীর জোয়ারে ভাসল স্বদেশ। বাহাত্তরের দশই জানুয়ারি ফিরে আসেন গণ মানুষের এই নেতা। যিনি মুক্তি যুদ্ধের নয় মাস সশরীরে উপস্থিত না থেকেও নেতৃত্ব দিয়েছেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে চিন্তায় এবং চেতনায়। দেশের মাটিতে নেমে মাটি ছুঁয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেন এই সাহসী মানুষটি। হাজারো জনতার ভিড়ে এক কিশোরও সেদিন সাক্ষী হয়ে রইল সেই ইতিহাসের।
কিছুদিনের মধ্যেই দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটতে থাকে যা নিয়ন্ত্রণে সরকার ব্যর্থ হয়। মানুষের মনে দেখা দেয় হতাশা যা থেকে জন্ম নেয় ক্ষোভের। অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সরকার গঠন করে রক্ষীবাহিনী। সেই সময় উত্থান ঘটে কিছু সশস্ত্র রাজনৈতিক দলের যাদেরকে দমন করতে যেয়ে রক্ষীবাহিনী নিপীড়ন চালায় নিরীহ মানুষের উপরও। এতে সরকারের ভাবমূর্তি অনেকাংশেই ম্লান হয়ে পড়ে। আমি নিজেও তাঁদের নির্যাতনের শিকার হই, তখন আমি দশম শ্রেণির ছাত্র। আমাদের নরসিংদীর গ্রামের বাড়িতে আমার দাদীকে রেখে ফিরে আসছি। অপেক্ষা করছি হাতিরদিয়া বাজারে বাসের জন্য এমন সময় দেখি রক্ষীবাহিনী এবং পুলিশের যৌথ কনভয় আসছে ধুলা উড়িয়ে। অনেককেই দেখলাম ভয়ে সামনে থেকে সরে পড়ছে। কনভয় এসে থামল বাজারের মধ্যে। একটু পরেই ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে তাঁরা ছড়িয়ে পড়ল। চার পাঁচ জনের একটি দল বাস স্ট্যান্ডে অপেক্ষারত যাত্রীদের উপর তল্লাসি চালাচ্ছে। দুজন এগিয়ে আসে আমার দিকে জানতে চায় কত্থেকে এসেছি কোথায় যাব, যা কিনা স্বাভাবিক। কিন্তু হঠাৎ করেই পিছন থেকে আরও দুইজন এসে আমার জুলপি ধরে টানতে থাকে আর বলেতে থাকে এত বড় চুল কেন। প্রতিবাদ করায় লাঠি দিয়ে আঘাত করে পশ্চাৎদেশে। এরপর আমার ব্যাগে তল্লাসি চালিয়ে বের করে আনে আমার প্রিয় সনি পকেট রেডিও আর হেড ফোন। তখনকার সময়ের গান বা খবর শোনার একমাত্র বহনযোগ্য এই যন্ত্রটি আমার বাবা কানাডা থেকে আমাকে এনে দিয়েছিলেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করে এটা কি, আমি বলি রেডিও। ওরা নিজেদের মধ্যে চোখাচোখি করে, বলে না এটা ওয়্যারল্যাস এবং আমি নাকি সর্বহারা পার্টির সদস্য। এই বলে টানতে টানতে নিয়ে চলে তাঁদের ট্রাকের দিকে। মাঝপথে দেখি হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন আবদুল হাকিম চাচা যিনি নাকি স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা এবং আমাদের পারিবারিক বন্ধু। কেউ হয়ত আমাকে দেখে তাকে খবর দিয়েছিল। উনি আমাকে উদ্ধার করে বাসে তুলে দেন। বাসায় এসে সব বলার পর ছেলের কষ্টে আম্মার চোখ ছল ছল করতে লাগল আর আব্বা খুব রেগে যান। তক্ষুনি ফোন করেন ওয়াহিদুজ্জামান ফুপাকে। ফুপার ভাই ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান তখন ছিলেন রক্ষীবাহিনীর প্রধান (তিনি বঙ্গবন্ধুর সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলারও আসামী ছিলেন)। আর ফুপা ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের স্কুল জীবনের বন্ধু। তাঁর পক্ষে কথা বলার জন্যই তাজউদ্দীন আহমদ মুসলিম গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। কিছুক্ষণ পর নুরুজ্জামান চাচা ফোন করে দুঃখ প্রকাশ করেন এবং জানান দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে তিনি অবশ্যই ব্যবস্থা নেবেন এবং নিয়েছিলেন।
পরের অংশ
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি
|