বাবার কথা কামরুল মান্নান আকাশ
বয়ে চলা জীবনে দিন যত গড়িয়ে যায় ততই মনে হয় অতীত সামনে এসে দাঁড়ায়। যে সময় চলে যায়, যে জীবন ফেলে আসি তাই এক সময় এসে মনে হয় অমূল্য সম্পদ। বাবাকে নিয়ে লিখতে বসেছি, বাবার জীবনী নয়। নিতান্তই টুকরো টুকরো কিছু ছবি, এতে নেই কোন ধারাবাহিকতা। হয়ত এত বড় লেখা পড়ার ধৈর্যও কারও থাকবে না। আব্বার কথা লিখতে ভালো লাগছে, ভাবতে ভালো লাগছে তাই লিখছি। এখন রাত বাজে বারটা, ৩০শে এপ্রিল শুরু হল।
আজ থেকে দশ বছর আগে ২০০৭ এর এই দিনে আমার অনেক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা আর অনুপ্রেরণার যে মানুষটি সেই প্রিয় বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যান। আজ নেই অভিযোগ জানানোর, অভিমান করার কোন আশ্রয়। আব্বা-আম্মা যখন আমার এখানে সিডনীতে বেড়াতে আসতেন প্রতিবার ফিরে যাওয়ার সময় আমি শিশুর মতই কাঁদতাম। আব্বা বলতেন ““আমার বাবা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন, একদিন আমিও যাব এবং তোমাকেও যেতে হবে - এটাই নিয়ম। দাদাভাই প্রত্যয়-পৃথ্বীর মাঝে আমাদেরকে খুঁজো, ওদের মাঝেই আমরা বেঁচে থাকব”“। বাব-মা হারানোর বেদনা আজীবনের। এ দুঃখ কখনোই শেষ হয়ে যায়না। আমার বাবা ছিলেন একজন সফল বিজ্ঞানী, আদর্শ শিক্ষক এবং দক্ষ প্রশাসক। কিন্তু তাঁর মাঝে বাস করত এক দার্শনিক ও কবি। তিনি একসময় ““মহিগীর”“ ছদ্মনামে লেখালেখি করতেন এবং একটি মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সবার উপরে ছিলেন এক অসাধারণ বাবা। এমন বন্ধু, এমন নিঃস্বার্থ ভালবাসার জন এ জীবনে আর আসবে না। আমদের দিয়েছেন এক চমৎকার জীবন, অবাধ স্বাধীনতা আর আপন সত্ত্বায় বেড়ে উঠার সুযোগ। কোনদিন জোর করে আমাদের উপর কিছু চাপিয়ে দেন নি।
যখন শুনলাম আব্বা স্ট্রোক করে হাসপাতালে আছেন সাথে সাথেই দেশে ছুটে যাই। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা ক্লিনিকে চলে আসি। আমাকে দেখে আই সি ইউ-তে শায়িত আমার বাবার চোখ থেকে অশ্রু গড়িয়ে পড়ে, বললেন আমি জানতাম তুমি আসবে। আর আমি বাইরে কান্না আটকে রেখে মনে মনে চিৎকার করে কাঁদতে থাকি আমার নায়ক, আমার আদর্শ, কখনো হার না মানা অসম্ভব সাহসী একজন মানুষকে সারা শরীরে বিভিন্ন রকমের নল নিয়ে অসহায় ভাবে শুয়ে থাকতে দেখে। আমি কোনদিন তাকে কাঁদতে দেখিনি, না ভুল বললাম দেখেছি দু’একবার। একবার যখন আমার দাদী মারা যান আর একবার আমার বোনের বিয়ের সময় অনুপস্থিত বিদেশে থাকা বড় ভাইয়ের জন্যে, আর শেষবার ২০০৬-এ আমি যখন দেশ থেকে সিডনীতে ফিরে আসছি, বিচ্ছেদের বেদনায় সেদিন বাবা-ছেলে মিলে গলা ধরে অনেক দুঃখে মনের সুখে কেঁদে ছিলাম।
আমার বাবা ছিলেন প্রচণ্ড সৌখিন একজন মানুষ। সবসময়ই তাঁকে দেখেছি ক্লিন শেভড এবং যথাযথ ড্রেস-আপ করা অবস্থায়। আজ আব্বার মুখে এক সপ্তাহের না কাটা দাড়ি। এটাও আমার জন্য নতুন। আব্বাকে বললাম কালকে আমি দাড়ি কেটে দিব, শুনে খুশি হলেন। পরদিন শেভ করার পর আয়না চাইলেন, দেখে বললেন ভালোই কেটেছ। শত বিপদ ও কষ্টের মাঝেও এমন স্বাভাবিক থাকতেন তিনি। অসুস্থ অবস্থায় আব্বার সাথে কাটানো পাঁচটি সপ্তাহ আমার জীবনের এক অমূল্য সম্পদ। নড়তে চড়তে পারতেন না, কথা বলতেন কিছুটা জড়িয়ে কিন্তু চিন্তা-চেতনায় ছিলেন স্বচ্ছ ও পরিষ্কার। আমি পত্রিকা পড়ে শুনাতাম, তিনি মন্তব্য করতেন, দেশে নিয়ে উদ্বিগ্ন হতেন। পাঁচ সপ্তাহের মধ্যে তিনবার আই সি ইউ-তে নিতে হয়েছে। প্রতিবারই মনে হয়েছে বোধহয় আর ফিরবেন না। আম্মার প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল তুলনাহীন, এই অবস্থায় যে দিন ভাল থাকতেন ফোনে আম্মার সাথে কত কথাই না বলতেন! আব্বা ছিলেন ডায়াবেটিক হাসপাতালে, এই সেই প্রতিষ্ঠান যেটি গড়ে তুলতে তিনি ডাঃ ইব্রাহিমের সাথে থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। সেই সেগুন বাগিচার কয়েকটি রুম নিয়ে প্রতিষ্ঠিত ডায়াবেটিক সেন্টার থেকে শাহবাগের এই বিশাল হাসপাতাল পর্যন্ত। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি ছিলেন এর প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা এবং পরবর্তীতে ভাইস প্রেসিডেন্ট। ডাঃ ইব্রাহিম আব্বাকে খুবই স্নেহ করতেন এবং ওখানে পরিচালক করে নিয়ে যেতে চাইতেন। কিন্তু আব্বার প্রিয় ছিল শিক্ষকতা, ছাত্রদের নিয়ে থাকতে খুব পছন্দ করতেন। হাসপাতালে থাকাকালীন এক বিদেশ প্রত্যাগত সিনিয়র ডাক্তারের কাছে চিকিৎসায় অবহেলার কারণ জানতে চাইলে আমার সাথে খারাপ ব্যাবহার করে। তখন হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ ইব্রাহিমের মেয়ে ডাঃ হাজেরা মাহতাব সেই ডাক্তারকে বলেছিলেন আপনি হয়ত জানেন না এই হাসপাতাল ডঃ মান্নানের কাছে কতটুকু ঋণী!
আমি ছিলাম আমার বাবার ছায়া সঙ্গী। আব্বা যেখানে যেতেন সাথে আমিও যেতাম। অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলতেন। এর কারণ বোধহয় কেউ যখন কোন প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ আসনে থাকেন তাঁর বিশ্বাস করার মত বন্ধু বলে কেউ আর থাকেনা, চাটুকার আর স্বার্থান্বেষীরা এসে ভিড় করে। এটা আরও বেশী করে প্রযোজ্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বেলায়। এ যেন ঢাল নাই তলোয়ার নাই নিধিরাম সর্দার! মনে আছে আব্বা উপাচার্যের দায়িত্বভার গ্রহণের পর সম্বর্ধনা সভায় টি এস সি অডিটোরিয়াম ভর্তি ছাত্র, শিক্ষক, কর্মচারীর উদ্দেশ্যে বলেছিলেন আমি গ্রামের স্কুলের এক শিক্ষকের সন্তান হয়ে আজ বাংলাদেশের সর্বোচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছি শুধুমাত্র মেধা এবং অধ্যবসায়ের জন্যে এবং তোমরাও পারবে যদি নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাক। ছাত্ররা সেদিন প্রচণ্ড ভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। আমার বাবা ছিলেন সেই সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় একজন শিক্ষক এবং দেশবরেণ্য বিজ্ঞানী। সেই সময়কার বিজ্ঞানীদের তালিকার শীর্ষে ছিলেন তিনি, দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সায়েন্টিফিক জার্নালে সর্বোচ্চ গবেষণাপত্র প্রকাশনার কারণে। এই ক্ষেত্রে তাঁর সবচেয়ে বড় সাফল্য ছিল বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী ঔষধ-নীতি প্রণয়ন, যা দেশে বিদেশে অসাধারণ প্রশংসা লাভ করে। আমার বাবা ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সব চেয়ে বেশী ভোট পেয়ে নির্বাচিত উপাচার্য।
আমি অনেক ঘটনার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। কত রাজনৈতিক নেতা, ছাত্র নেতা, শিক্ষক নেতা, এম পি, মন্ত্রী, আমলা, দেশ বরেণ্য বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, শিল্পপতি, কূটনীতিক, পুলিশ, সামরিক বেসামরিক গোয়েন্দা, পীর-ফকির সহ আরও কত রকমের কত রঙের মানুষের যে আনাগোনা চলত উপাচার্য ভবনে তাঁর ইয়ত্তা নেই। আর তাদের প্রাথমিক অভ্যর্থনা আমাকেই জানাতে হত। এদের মধ্যে যেমন দেখেছি অনেক ভাল ও গুনি মানুষ তেমনি দেখেছি অসৎ ও ভণ্ড মানুষ। এই সব বড় বড় মানুষদের অনেকের মনের দীনতা এবং হীনতা দেখে হতাশ হয়েছি। আমি অবাক হয়ে দেখতাম কি অসাধারণ বুদ্ধি ও মেধার সাথে আব্বা এ সব সামলাতেন। দেখতাম শুধু মাত্র তাঁর ব্যক্তিত্ব দিয়ে কি করে বিক্ষুব্ধ ছাত্রদের বিশাল মিছিল, ঘেরাও, উচ্ছশৃংখলতা এবং ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবেলা করতেন অসীম সাহসের সাথে।
আমার বাবা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কাজ করে গেছেন নিরলস ভাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়ার পর পাবলিক সার্ভিস কমিশনে সদস্য হিসাবে ছিলেন এবং রাজনৈতিক কারণে তাকে চেয়ারম্যান না করে অন্য একজনকে করা হয়। আমার জানা আছে সেখানকার চমকপ্রদ সব ঘটনা। এরপর তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বাংলাদেশের ষষ্টিতম বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ““পিপলস ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশ”“ এবং ““ফাউন্ডেশন ফর পিপলস এডুকেশন”“। যার উদ্দেশ্য ছিল মেধাবী অসচ্ছল ছাত্রদের বিনাবেতনে এবং অন্যদের স্বল্পব্যায়ে শিক্ষা প্রদান করা। এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করার প্রস্তাব করেন আব্বার বন্ধু-স্থানীয় সাধারণ সম্পাদক জনাব জিল্লুর রহমান এবং মন্ত্রিত্বের কথাও বলা হয়। এটা ছড়িয়ে পড়ার পর এলাকার মানুষের সমাগম বেড়ে যায় আব্বাকে রাজী করানোর জন্য। আমিও চাচ্ছিলাম আব্বা রাজনীতিতে আসুক। কিন্তু আব্বা বললেন না এটা আমার কাজ না, আমাকে তাহলে এমন অনেক কিছু করতে হবে যা আমার নীতি বিরুদ্ধ। আরও বললেন হুমায়ূন (নুরুল মজিদ হুমায়ুন, আমাদের এলাকার বর্তমান এম পি) এতদিন ধরে তাঁর পর্টির জন্য কাজ করছে তাকেও বঞ্চিত করা হবে।
আমার আব্বা ছিলেন একজন আধুনিক, ধার্মিক, অসাম্প্রদায়িক এবং উদার মনের মানুষ। শত ব্যস্ততার মাঝেও উনাকে নামাজ মিস করতে দেখিনি কোনদিন। গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামায পড়তেন এবং সকালে পবিত্র কোরান পড়তেন। আবার যখন জগন্নাথ হলের ছাত্ররা আব্বাকে অনুরোধ করে বলল যে আমাদের একটি পূজা মণ্ডপ দরকার কিন্তু আগের সব উপাচার্যের কাছেই আবেদন করে ব্যর্থ হয়েছি। তখন আব্বা শত সমালোচনা উপেক্ষা করে তাদের পূজা মণ্ডপ করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন এবং সেটি তাঁর সময়েই নির্মিত হয়।
আব্বার কথা লিখতে যেয়ে এত কথা, এত স্মৃতি এসে মনে ভিড় করছে যে কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে পানিতে, বুকের মধ্যে কেমন যেন ভার বোধ করছি, তবু শুধু লিখতেই ইচ্ছে করছে। আব্বার ইচ্ছা ছিল তাঁর ঘটনাবহুল জীবনের কথা লিখে যাবার। আমাকে কিছু ডিক্টেশনও দিয়েছিলেন কিন্তু আমি বিদেশে চলে আসার কারণে সেটা আর লেখা হয়নি। আজ মনে হচ্ছে সেটা লেখা দরকার পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে।
আব্বা সব সময় আমাদের সবার জন্মদিন পালন করতেন। আমার পঞ্চম জন্মদিনে উপহার দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের ““সঞ্চয়িতা”“। এত মোটা একটি বই পেয়ে খুব খুশী হয়েছিলাম। আব্বা মাঝে মাঝে ওখান থেকে কবিতা পড়ে শুনাতেন। তখন থেকেই এটি আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। যে বছর বিদেশে চলে আসি আব্বা তখন তাঁর প্রতিষ্ঠিত পিপলস ইউনিভার্সিটি অফ বাংলাদেশের উপাচার্য। একদিন দুপুরে ফোনে করে আমাকে ইউনিভার্সিটিতে যেতে বলেন। সেখান থেকে নিয়ে যান মেমরি বেকারি এন্ড পেস্ট্রি শপে। যেয়ে দেখি আমার জন্মদিন উপলক্ষে আগে থেকেই অর্ডার দিয়ে রেখেছিলেন বিশাল এক কেক যা নাকি ৪০ জন খেতে পারে অথচ তখন বাসায় মাত্র ৬ জন মানুষ! আমি বললাম এত বড় কেক! আব্বা আবেগ প্রবণ হয়ে গেলেন বললেন আমি হয়ত আর তোমার জন্মদিন পালন করতে পারবনা।
অসুস্থ আব্বাকে রেখে যেদিন আমি চলে আসি তখন আব্বা আবার আই সি ইউ তে। আমি যখন সালাম করছি উনার তখন ডায়ালিসিস চলছে। বললেন আমাকে সালাম করছ কেন? বললাম আমাকে তো আজ চলে যেতে হবে। আব্বা বললেন হ্যাঁ তোমার তো যাওয়াই দরকার প্রত্যয়-পৃথ্বী-মিনির কাছে, আমার জন্যে ভেবোনা আমি ভালো হয়ে বাসায় ফিরে যাব। কি অসম্ভব মনের জোর! আমি কান্না লুকিয়ে বেড়িয়ে এলাম।
সিডনীতে ফিরে আসার তিন সপ্তাহ পর আব্বা বেশ কিছুটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে যান। কিন্তু তাঁকে বিছানায় বন্দী হয়েই থাকতে হচ্ছিল। ছাব্বিশ কি সাতাশে এপ্রিল সকাল সাতটার মত বাজে আমি আমার কর্মস্থলে যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছি হঠাৎ ফোন বেজে উঠল। অজানা আশংকায় বুক কেঁপে উঠে। ফোন তুলেই শুনি আব্বার গলা ওমনি আনন্দে মনটা ভরে গেল। আব্বা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন ““বাবা তুমি কেমন আছো। মন খারাপ করোনা। সব সময় আনন্দে থাকবে। আমাকে নিয়ে ভেবোনা আমি ভালো আছি”“। বললাম বাংলাদেশে তো এখন রাত তিনটা বাজে, অনেক রাত। বললেন তোমার কথা খুব মনে পড়ছে, কথা বলতে ইচ্ছে করছে তাই ফোন করলাম। কাজে যাচ্ছি শুনে বললেন তুমি কোটের সাথে টাই পড়না, টাই পড়ে যেও। সেই শেষ কথা।
এরপর ৩০ শে এপ্রিল ২০০৭, আমি তখন অফিসে, আমার মেয়ে পৃথ্বী কাঁদতে কাঁদতে ইউনিভার্সিটি (আমার অফিসের পাশেই ওর ইউনিভার্সিটি) থেকে এসে জানাল সেই দুঃসংবাদটি যার আশংকায় বিদেশে কেটেছে নয়টি বছর। আবার উড়ে যাই দেশে সাথে আমার মেয়ে পৃথ্বী। ও ছিল আমার বাবা-মায়ের সার্বক্ষণিক সঙ্গী। পরীক্ষা বাদ দিয়ে আমার মেয়ে চলল তাঁর প্রিয় দাদুকে শেষ বিদায় জানাতে। ও আমাকে বলে বাবা পরীক্ষা তো পরেও দিতে পারব কিন্তু দাদুকে আর পাবনা! মনে পড়ে আব্বা-আম্মাকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি – বলেছিলাম তোমাদের অসুস্থতার কথা শুনলেই চলে আসব, আর শেষ সময়ে কাছে থাকব। আমি নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে করি যে আল্লাহ-সোবহানুতাআলার অশেষ রহমত যে আমি দুজনকেই কাঁধে বহন করেছি এবং নিজের হাতে কবরে শুইয়ে দিয়েছি।
আব্বাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাই তাঁর জন্মস্থল প্রিয় নরসিংদী জেলার মনোহরদী থানার সৈয়দপুর গ্রামে। যেখান থেকে তিনি একদিন এক সম্ভাবনাময় ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করেছিলেন এবং সফল জীবনের পরিভ্রমণ শেষে আবার সেখানেই ফিরে গেছেন। হাতিরদিয়া সাদত আলী হাই স্কুল প্রাঙ্গণে এই স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্রের জানাজায় দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসা হাজার হাজার মানুষের কাছে সন্তান হিসাবে আমি দোয়া চেয়ে বলি আপনাদের প্রিয় সন্তানকে আপনাদের কাছেই রেখে গেলাম।
আমার বাবা আমাদের শিখিয়েছেন জীবনে যত বড় হবে তত বেশী বিনয়ী হতে এবং অন্যায়ের সাথে আপোষ না করতে। তাই কোন অহংকার নয় আমি আমার বাবাকে নিয়ে গর্ব করি যে আমি একজন আলোকিত মানুষের সন্তান।
সবাই দোয়া করবেন যেন আল্লাহ সুবহানুতাআলা আমার বাবা-মাকে ক্ষমা করেন এবং দান করেন বেহেশতের সর্বোচ্চ স্থান জান্নাতুল ফেরদৌস। আমীন।
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি
|