আমার মা / কামরুল মান্নান আকাশ
আগের অংশ
আম্মা নিয়মিত কোরান শরিফ পড়তেন এবং নামাজ আদায় করতেন। বাসায় মৌলবি সাহেব আসতেন আমাদের কোরান শরিফ পড়াতে, অনিয়মিত হলেও নামাজ পড়তাম। পরে আস্তে আস্তে নিয়মিত হয়ে যাই। আমার ছোট্ট প্রত্যয়ের নামাজ পড়া দেখে আম্মা খুব খুশি হতেন। আম্মার মধ্যে ছিলনা কোন ধরণের গোঁড়ামি। আমাদের সব গৃহ শিক্ষকই ছিল জগন্নাথ হলের ছাত্র।
কি করে একটি পরিপূর্ণ জীবন যাপন করতে হয় তার শিক্ষা ছোটবেলা থেকেই পেয়েছি। আমার মা আমাদের পড়াশুনা, ধর্ম পালন, খেলাধুলা এবং সংস্কৃতির চর্চা সবকিছুতেই উৎসাহ যুগিয়েছেন। তাই আমরা ভাই বোনরা ছোটবেলা থেকেই গান, নাচ, নাটক, গিটার বাদন, তবলা বাদন, লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। সবচেয়ে বেশি যেটা শিখিয়েছেন তা হল মানুষকে ভালবাসতে।
আমার আম্মা ছিলেন ধীর, স্থির শান্ত স্বভাবের একজন বুদ্ধিমতী মহীয়সী নারী।আব্বা সব সময় সবখানে বলতেন আমার জীবনের যেটুকই অর্জন তার পিছনে আমার স্ত্রীর অবদান অপরিসীম। সে যদি সংসারের সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে না নিত তাহলে আমি আমার কাজের জন্য এত সময় ব্যয় করতে পারতামনা। শেষবার যখন আমি দেশে যাই আম্মা খুব অসুস্থ ছিলেন। নার্স বাসায় এসে প্রতিদিন ডায়ালিসিস করে যেত। সেই সময় আব্বা স্ট্রোক করে হাসপাতালে ছিলেন এবং আমি আব্বার সাথেই থাকতাম। তখন আম্মা যেন কি এক মনোবলে কিছুদিনের জন্য আগের মত কর্মঠ হয়ে উঠেন। আমার সব পছন্দের রান্না করে পাঠাতেন। আগের মত হাসতেন, পান খেতেন। এখন বুঝি এসবই করতেন আমাদের সাহস দেওয়ার জন্য।
আমি পাঁচ সপ্তাহ দেশে ছিলাম, কিন্তু পুরো সময়টাই কাটিয়েছি আব্বার সাথে। আম্মার সাথে একটি দিনও বাসায় থাকতে পারিনি এবং আর কোনদিনই সেই সুযোগ হয়নি। সিডনিতে যেদিন চলে আসি আমার স্বল্পভাষী মা যার ভালবাসা বুঝে নিতে হয় চোখের দিকে তাকিয়ে কিংবা পাশে দাঁড়িয়ে থাকা দেখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেন তুমি আবার কবে আসবে বাবা! আমার কান্না চলে আসে আমিও আম্মাকে জড়িয়ে ধরে বলি যেদিন শুনব তুমি বেশী অসুস্থ হয়ে গেছ সাথে সাথে চলে আসব।
এরপর কেটে গেছে প্রায় সাত মাস। ২০০৭ এর ঠিক এই ডিসেম্বরে কেন যেন প্রচণ্ড অস্থির হয়ে উঠি শুধু মনে হচ্ছিল আম্মার যদি কিছু হয়ে যায়। বাসায় ফোন করলাম আমার খালা ফোন ধরে বললেন তোমার আম্মাকে তো এই মাত্র হাসপাতালে নিয়ে গেল। তুমি কেমন করে জানলে যে তোমার মা খুব অসুস্থ। বললাম জানিনা। সাথে সাথে উড়ে যাই দেশে। সোজা চলে আসি ক্লিনিকে মায়ের কাছে। কিন্তু ততক্ষণে আমার মা চলে গেছেন কোমা-তে। আমি চিৎকার করে বলতে লাগলাম মা দেখ আমি এসেছি। কিন্তু আমার অভিমানী মা একবারও চোখ খুলে চাইলেন না, একটি কথা বললেন না, জিজ্ঞেস করলেন না বাবা তুমি কেমন আছ। আমি মনে মনে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলাম মা আমি তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারিনি; আমি সময় মত আসতে পারিনি; আমাকে ক্ষমা কর মা।
ডাক্তাররা যখন লাইফ সাপোর্ট খুলে নেয়। ঠাণ্ডা হয়ে যাওয়া শরীরে হাত দিয়ে, চোখ বন্ধ করে রাখা শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে মনে হচ্ছিল আমার মা যেন ঘুমিয়ে আছে। ভাবতেও পারছিলামনা এ ঘুম আর কোনদিন ভাঙ্গবে না। সময় যেন থমকে যায়, সব কথা, সব কান্না থেমে যায়। মনে হল অনন্তকাল ধরে চেয়ে আছি মায়ের দিকে, চোখ সরালেই হারিয়ে ফেলব মাকে।
আব্বা-আম্মা আগেই আমাদের বলে রেখেছিলেন মৃত্যুর পর দুজনকে যেন পাশাপাশি কবর দেই দাদা-দাদীর পাশে। আম্মাকে নিয়ে যাই আমাদের গ্রামের বাড়িতে যেখানে তিনি একদিন বউ হয়ে এসেছিলেন। সবাইকে বলি এই গ্রামের যে বধূটি আপনাদের ভালবেসেছিল তাকে আপনাদের ভালবাসার কাছেই রেখে যাচ্ছি। নিজের হাতে মাকে শুইয়ে দেই বাবার পাশে। মায়ের কপালে শেষ চুমু দিয়ে অপলক তাকিয়ে থাকি। তাকিয়ে থাকি পৃথিবীর সবচাইতে নিঃস্বার্থ, সবচাইতে দামী ভালবাসার দিকে। এখনো আমি মাঝে মাঝে স্বপ্নে আমার মাকে দেখি, সেই ছোট বেলায় দেখা মাকে। পানের রঙে রাঙানো টুকটুকে লাল ঠোঁট, মধুর হেসে বলছেন বাবা তুমি কবে আসবে - আমি গ্রাম থেকে তোমার প্রিয় হাতে কুটা মাস ডাল আনিয়ে রেখেছি, মিনির জন্য চ্যাপা শুটকি, বইগুলো নিতে ভুলনা, পৃথ্বীর জিনিষ গুলো আর প্রত্যয়ের ফেলে যাওয়া গেমের ডিস্ক। আমি বলি ওরা যে বলল তুমি নাই! আম্মা হেসে বলে, কে বলেছে, এই যে আমি – আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। আকাশের সবচেয়ে উজ্জ্বল তারাটার দিকে তাকিয়ে মনে মনে চিৎকার করে বলি মা কোথায় তুমি? আর একটি বারের জন্য যদি তোমাকে মা বলে ডাকতে পারতাম!
সবাই দোয়া করবেন যেন আল্লাহ সুবহানুতাআলা আমার বাবা-মাকে ক্ষমা করেন এবং দান করেন বেহেস্তের সর্বোচ্চ স্থান জান্নাতুল ফেরদৌস। আমীন।
আগের অংশ
কামরুল মান্নান আকাশ, সিডনি |