শহীদ মিনারের বিশ্বায়নে দেশ-ব্রতী নির্মল পাল অজয় কর
মাতৃভাষার চেতনায় শহীদ মিনারকে বিশ্বায়ন করার মধ্যে দিয়ে সকল মাতৃভাষাকে সংরক্ষণ ও বিকাশের জন্যে নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন সিডনী প্রবাসী বাংলাদেশের ছেলে নির্মল পাল- নির্মল পালের বই 'বিশ্বায়নে শহীদমিনার' তারই স্বাক্ষর দিচ্ছে। এবছর ঢাকার একুশে বই মেলায় এই বইটির মোড়ক উন্মোচন করেন লেখিকা সেলিনা হোসেন। সকল মাতৃভাষার প্রতি সন্মননা জানাতে নির্মল পালের এই কাজের মধ্যে কানাডা প্রবাসী সদ্য প্রয়াত ভাষা সৈনিক রফিকুল ইসলাম তার কল্পনার প্রতিচ্ছবি দেখেছেন। নির্মল পালের এই কাজকে স্বীকৃতি দিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটের মহাপরিচালক অধ্যাপক জীনাত ইমতিয়াজ আলী নির্মল পালকে রফিক-সালামের এক সহযোদ্ধা বলে মন্তব্য করেছেন।
সকল মাতৃভাষা সংরক্ষণে নির্মল পালের উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশ হাই কমিশনের বর্তমান হাইকমিশনার লে: জেনারেল মাসুদ উদ্দিন চৌধুরী। স্বাধীনতা পদকে ভূষিত প্রফেসর যতীন সরকার নির্মল পালের এই কাজের উপর মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন 'শুধু কর্মযোগী নন, নির্মল পাল যথার্থ দেশ-ব্রতী।' পদ্মভুষন পদকপ্রাপ্ত বাংলা একাডেমির সভাপতি প্রফেসর আনিসুজ্জামান বইটির মুখবন্ধে লিখেছেন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসকে কীভাবে সফল করা যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত পরিকল্পনা সন্নিবেশিত হয়েছে বইটিতে।
অনলাইন বাংলাপত্রিকা বাংলা-সিডনী ডট কম থেকেই 'বিশ্বায়নে শহীদমিনার' বইটির ব্যপারে জানতে পারি। এর পর বইটির লেখক নির্মল পালের সাথে কথা বলে যখন জানলাম যে ক্যানবেরাতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে বইটির কপি রয়েছে, তখন সেখান থেকে সংগ্রহ করে বইটি পড়েছি।
বাংলাদেশ হাই কমিশন ক্যানবেরা কর্তৃক আয়োজিত ২০১৩ সনের আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ব্যক্তির আলোচনা ও পরামর্শের আলোকে নির্মল পাল এই বইটির কাজ শুরু করেন বলে লিখেছেন বইটিতে। আমার সৌভাগ্য হয়েছিল সেই আলোচনায় অংশ নেওয়ার। এর আগে, বাংলাদেশ হাউজ-এ ২০১৩ সালের ১৯ জানুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন উপলক্ষে ক্যানবেরায় প্রভাতফেরী ও MLC Movement-এর কৌশল গত দিক নিয়ে যে মিটিং হয়েছিল সেই মিটিং-এ উপস্থিত থেকে জেনেছি যে নির্মল পাল মাতৃভাষা চর্চা ও সংরক্ষণে পৃথিবীর সব মানুষের বোধোদয় এর লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন।
পুলিশের গুলিতে ৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে নিহত ৪ জনকে শহীদের মর্যদা দিতে যে চেতনা নিয়ে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ২৩ ফেব্রুয়ারি রাতের মধ্যে 'শহীদমিনার গড়েছিল সেই একুশের চেতনাকে লালন করে কিভাবে বিশ্বের সব ভাষা সংরক্ষণের লক্ষে ২০০৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারিতে সিডনিতে পৃথিবীর প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধ প্রতিষ্ঠা হয়েছিল, তার ইতিহাস ভালোভাবে জেনেছি এই বইটি পড়ে।
কানাডা প্রবাসী রফিক ও সালাম এবং তাদের সহযোগী সংস্থা মাতৃভাষা প্রেমিক সঙ্ঘের উদ্যোগে কিভাবে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসাবে UNESCO-এর স্বীকৃতি লাভ করেছিল তারও ধারাবাহিক বর্ণনা রয়েছে বইটিতে।
UNESCO- এর বরাত দিয়ে লেখক লিখেছেন যে, সাত সহস্রাধিক মাতৃভাষায় সমৃদ্ধ বিশ্ব মাতৃভাষা-ভাণ্ডার থেকে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ পর্যায়ে এসে প্রায় দুই হাজার মাতৃভাষা অবলুপ্ত হয়েছে। অবলুপ্তির এই ধারা চলতে থাকলে অদূর ভবিষ্যতে আরও প্রায় তিন হাজার মাতৃভাষা বিলীন হওয়ার আশংকা রয়েছে। মাতৃভাষার অবলুপ্তি রোধে বিশ্বজুড়ে মাতৃভাষা সংরক্ষণে গণজাগরণ সৃষ্টির জন্যে নির্মল পাল ২০০৭ সালে MLC Movement International Inc. প্রতিষ্ঠা করেন। প্রতিষ্ঠানটির 'মনোগ্রাম' হিসাবে বেছে নেন অন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস স্মৃতিসৌধের প্রতিকৃতিটিকে। মাতৃভাষার চর্চা ও তার সংরক্ষণে বিশ্বজুড়ে গণসচেতনতা জাগাতে বেছে নেন Conserve Your Mother Language-এই শ্লোগানকে।
এই বইটি পড়ে জেনেছি নির্মল পাল তার লক্ষ্যে পৌছাতে অনেক বাধাবিপত্তির মুখোমুখি হলেও থেমে যান নি। বাধাবিপত্তি পেড়িয়ে নীরবে কাজ করে চলেছেন দশের জন্যে, দেশের জন্যে। কাজ করে যাচ্ছেন দেশে বিদেশে বিভিন্ন লাইব্রেরীতে একুশে কর্নার প্রতিষ্ঠার জন্যে।
বিশ্বের সকল মানুষের মাতৃভাষাকে অবলুপ্তির হাত থেকে ঠেকাতে নির্মল পালের এই উদ্যোগ নিঃসন্দেহে মহৎ। আসুন সকলে মিলে আমাদের ছেলে, বাংলাদেশের ছেলে এই নির্মল পালকে তার এই মহৎ কাজে সহযোগিতা করি। আসুন সবাই মিলে মহান সৃষ্টি কর্তা'র কাছে দেশ-ব্রতী নির্মল পালের দীর্ঘ জীবন কামনা করি।
|