প্রবাস জীবনঃ সংস্কৃতির চর্চা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক অজয় কর
আমি ২০০৪ সালের মাঝামাঝি চাকরী নিয়ে ক্যানবেরা আসি। প্রবাস জীবনে বাংলাদেশীদের সাংস্কৃতিক হালচালের সাথে পরিচয় বলতে যা বুঝায় তার সবটাই আমার বলা যায় ক্যানবেরাতে।
ক্যানবেরায় বাংলাদেশীদের সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার সাথে আমার প্রথম পরিচয় ‘দৃষ্টিপাত’ নামক এক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের ফান্ড রেইজিং ইভেন্টের মাধ্যমে। দৃষ্টিপাত বাংলাদেশে সাভারের কিছু দুস্থদের সাহায্যের জন্যে অর্থ সংগ্রহের জন্যে এক সাংস্কৃতিক সন্ধ্যার আয়োজন করেছিল । সম্ভবতঃ ২০০৬ সাল হবে সেটা এবং সাংস্কৃতিক সন্ধ্যাটির আয়োজন হয়েছিল কোন এক চার্চের হলরুমে।
তার বেশ ক’বছর বাদে বাংলাদেশের এক শীত-মৌসুমে দিনাজপুরের গরীবদের হাড়-কাঁপানো শীত থেকে বাঁচাতে কম্বল সহ শীতবস্ত্র দেবার উদ্যোগ নিয়েছিল সেই সংগঠনটি । তাদের সেই ২য় উদ্যোগে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছিল না- সংগঠনটির কর্তা ব্যক্তিরা যাদের চিনতেন তাদের কাছে সাহায্যের জন্যে আবেদন করেছিলেন- আমি আমার সাধ্যমতো তাদের আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলাম। এখন ক্যানবেরাতে আদৌ সেই সংগঠনের কার্যক্রম রয়েছে কিনা আমি জানি না। তবে যতদূর জানি দৃষ্টিপাতের ২০০৬ সালের সেই ফান্ড রেইজিং ইভেন্টের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি যে সাংস্কৃতিক সংগঠনটি করেছিল তারা এখনও ক্যানবেরাতে তাদের গান বাজনা চালিয়ে যাচ্ছেন।
প্রবাসে বাঙালী সংস্কৃতিকে নাচ-গানে বাঁচিয়ে রাখতে ক্যানবেরার মতো এদেশে বিভিন্ন শহরে অসংখ্য বাংলাদেশী সংগঠন রয়েছে। এসব সংগঠনের অনেকেই দাবি করেন তারা বাঙালী সংস্কৃতিকে প্রবাসে সচল রাখতে ভলান্টারী কাজ করে যাচ্ছেন। কিন্তু এদের কার্যক্রম বলছে ভিন্ন কিছু। অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন শহরে খোজ নিয়ে বাংলাদেশীদের বাংলা সংস্কৃতি চর্চার যে চিত্র পাওয়া যায় তা ক্যানবেরার চিত্র থেকে ভিন্ন নয়। প্রায় প্রতি মাসেই একটার পর একটা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। টিকিট প্রতি দাম ধরা হচ্ছে ১০ থেকে ৫০ ডলার ক্ষেত্র বিশেষে টিকিটের দাম আর ও বেশি। এসব সংগঠনের অনেকেই তাদের অনুষ্ঠানের সার্থকতা পেতে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল অবলম্বন করেন।
প্রবাসে বাংলাদেশী শ্রোতা দর্শকদের অনেকেরই রয়েছে দেশের গরীব মানুষের প্রতি সহানুভূতি। আর তাদের সেই সহানুভূতিতে নাড়া দিয়ে তাদের কাছে অনুষ্ঠানের টিকিট বিক্রি করতে সচেষ্ট রয়েছেন এসব অনুষ্ঠানের অনেক আয়োজকরা। এসব আয়োজকদের অনেকেই তাদের অনুষ্ঠানে সহানুভূতিশীল এসব মানুষ জনকে দর্শক হিসাবে পেতে প্রচার চালান এই বলে যে তাদের অনুষ্ঠান থেকে অর্জিত লাভ (অর্থ) বাংলাদেশের চ্যারিটিতে দেওয়া হবে। কিন্তু লাভের কি পরিমাণ এরা দেশের চ্যারিটিতে দিচ্ছেন, কিংবা চ্যারিটিগুলি আদৌ সরকারী নিবন্ধন প্রাপ্ত কিনা- এসব নিয়ে দর্শকদের অনেকেই মাথা ঘামান না।
কিন্তু তাই বলে মনে করার কারণ নেই যে এসব দর্শকদের সবাই খুশি মনে তাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন বাংলা নাচ গান শুনতে।
ক্যানবেরাতে আমি এমন অনেককেই জানি যারা একা রোজগার করেন কিংবা দুজনে রোজগার করলেও ক্যানবেরার সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। এরা গান বাজনা ভাল বাসলেও টিকিট কিনে গানের অনুষ্ঠানে যাওয়া এদের অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠে না। তাই, এদের কেউ কেউ যখন আয়োজক বন্ধুর কাছ থেকে টিকিট কিনবার অনুরোধ পায় তখন বন্ধুত্বকে যাতে হারাতে না হয় সেই ভয়ে অনুষ্ঠানের টিকিট কিনলেও শেষমেশ অনুষ্ঠানে যায় না। এদের এই কৌশল নিতে হচ্ছে যাতে করে অনুষ্ঠানের আয়োজকরা তাদের সমস্যাটা বুঝতে পেরে দ্বিতীয়বার এদের কাছে অনুরোধ না নিয়ে আসে। এসব বন্ধুদের অনেকেরই আশঙ্কা যে এভাবে চলতে থাকলে প্রবাসে বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখা কষ্ট হবে কেননা আগে সংসার পরে বন্ধুত্ব।
এসব দর্শকদের অনেকেরই ধারনা আয়োজকরা বন্ধুত্বকে কাজে লাগিয়ে, বন্ধুর ইচ্ছা অনিচ্ছাকে আমলে না নিয়ে এবং বন্ধুর পকেটের অবস্থার কথা না ভেবে টিকিট গছিয়ে দিতে সচেষ্ট থাকে। এদের অনেকেরই রয়েছে সোজা সাপ্টা প্রশ্ন:
প্রবাসে বাঙালী সংস্কৃতিকে সচল রাখাই যদি হয় এদের লক্ষ তাহলে কমিউনিটি বাংলা স্কুলগুলিতে এদের জোরাল ইনভল্ভমেন্ট নেই কেন?
এরা যদি বাঙালী সংস্কৃতিকে ভালবাসার তাগিদ থেকেই এসব করে থাকেন, তাহলে নিয়মিত কমিউনিটি বাংলা স্কুলগুলিতে তাদের সন্তান দের পাঠান না কেন?
এরা যদি বাঙালী সংস্কৃতিকে এতোই ভালবাসবে তাহলে বাংলা ভাষাকে এদেশের মূলধারার স্কুলগুলির শিক্ষা কারিকুলামের অন্তর্ভুক্তির জন্যে কাজ করছে না কেন?
ওদের এসব প্রশ্নের উত্তর আমার ভাল জানা নেই তবে আমি জানি, এসব সংগঠন আছে বলেই প্রবাসে আমরা বাংলা সংস্কৃতির সাথে আর আমাদের শিকড়ের সাথে যোগসূত্র রাখতে পারছি।
আমি বলছি না প্রবাসে সংস্কৃতি চর্চা প্রয়োজন নেই। প্রবাসে সংস্কৃতি চর্চা’র প্রয়োজন অনেক। তবে, বন্ধুত্ব টিকিয়ে রেখে সংস্কৃতির প্রয়োজন মিটানোটাই বোধ হয় মঙ্গল জনক হবে সকলের জন্যে।
অজয় কর, ক্যানবেরা
|