অতিকায় মানুষ / আহমেদ শরীফ শুভ
আগের অংশ
এর পর থেকে ওদের রুটিন হয়ে গেল প্রতি শুক্রবার বিকেলে চিলাঙ্গায় যাওয়া, দুই দিন চুটিয়ে আড্ডা মেরে রবিবার সন্ধ্যায় হোটেলে ফিরে আসা। সবার পোস্টিং হতে লাগলো সাত সপ্তাহ। কেউ গেল লিভিংষ্টোনে, কেউ মাজাবুকা, কেউ চৌমা। সেলিমকে যেতে হলো সবচেয়ে দূরে। ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক অব কঙ্গোর সীমান্তবর্তী শহর মানসায়। দেশটির নাম অবশ্য তখন ছিল জায়ের। মানসা লুয়াপুলা প্রদেশের প্রাদেশিক রাজধানী হলেও আমাদের চাটমোহরের চেয়েও অনুন্নত। সেলিমের মন খারাপ হয়ে যায়। আচ্ছা, কেউ কি বিশ্বাস করবে জাম্বিয়ার একটা প্রাদেশিক রাজধানী বাংলাদেশের যেকোন উপজেলা শহরের চেয়েও অনুন্নত হতে পারে? ঝুমার নিশ্চয়ই মন খারাপ হবে। হয়তো লুসাকায় নেমেই ভাববে এ কোথায় এলাম! পরক্ষণেই নিজেকে সান্ত্বনা দেয়। জাম্বিয়াতো সাময়িক। আসল গন্তব্য তো দক্ষিণ আফ্রিকা। এখানে কয়টা দিন চাকরি করতে করতে সাউথ আফ্রিকান মেডিক্যাল কাউন্সিলের পরীক্ষায় পাশ করতে পারলেতো দিন বদলে যাবে।
এর মধ্যে মন্ত্রণালয়ের কাজে বা ছুটিতে প্ল্যান করে সবাই লুসাকায় যায়। মানসা থেকে সেলিম, মাজাবুকা থেকে সুব্রত, চৌমা থেকে মনু আর আজিম, আলতাফ আসে লিভিংষ্টোন থেকে। যদিও মন্ত্রণালয় লুসাকা হোটেলে থাকার ব্যবস্থা করে তবুও তপন আর দীপালি কর্মকারের কল্যাণে সে সুযোগ হয়না। তাদের লুসাকার সময় কাটে চিলাঙ্গার বাড়িতে। প্রত্যেক বারই নতুন নতুন ব্যাচের সাথে দেখা হয়। কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার কেউবা একাউন্টেন্ট। কেউ আছে পোষ্টিংয়ের অপেক্ষায়, কেউ ইন্টারভিউর। তপন কর্মকারের বাড়ি তাদের অন্তর্বর্তীকালীন আবাস। বাড়িতো নয় যেন লঙ্গরখানা।
ঝুমা আসে মাস তিনেক পর। মন্ত্রণালয় থেকে স্পাউস টিকিট ম্যানেজ করা যে কী ঝক্কি ঝামেলা! ফাইল যায় এই ডেস্ক থেকে ওই ডেস্কে। পদে পদে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা। ভাগ্যিস লুসাকার কর্মকর্তাদের মনতুষ্টিতে ঢাকার মতো বেশি খরচপত্র করতে হয়না। লুসাকা হোটেলে ডেকে নিয়ে ভরপেট বিয়ার খাইয়ে দিলেই গদগদ হয়ে কাজ করে দেয়। কিন্তু লুসাকার আমলাতন্ত্র ঢাকার চেয়েও জটিল। না দেখলে কে বিশ্বাস করবে!
কোয়াচার বেতনে দুই জনের সংসার টানা পোড়নে চলে। এভাবেতো চলবেনা। সেলিম কাজের ফাঁকে পড়ায় মন দেয়। সাউথ আফ্রিকায় পাড়ি দিতে না পাড়লে অর্থনৈতিক মুক্তি নেই। অনেকেই ইতিমধ্যে পাশ করে চলে গেছে।
মানসার মতো অজো পাড়াগাঁয়ে এসে ঝুমার মন সত্যি সত্যি খারাপ হয়ে যায়। বাংলাদেশের চেয়ে অনুন্নত কোন দেশ থাকতে পারে আর সেদেশে তার স্বামী সহ থাকতে হবে তা তার দুঃস্বপ্নেও কোনদিন ছিলনা। এখন অবশ্য আর কিছুই করার নেই। সেলিম যতো দিন সাউথ আফ্রিকার পরীক্ষায় পাশ না করছে ততদিন এখানেই মাটি কামড়ে থাকতে হবে। কিন্তু তাই বলেতো স্বামী স্ত্রীর প্রাত্যহিক জীবন আটকে থাকতে পারেনা। ঝুমার প্রেগনেন্সি টেস্ট পজিটিভ। দীপালি বৌদি তাকে ফোন করে ভরসা দিলেন, ‘ভয় পেওনা। আমরাতো আছি। ছেলে হোক মেয়ে হোক, দেখো এই বাচ্চা তোমাদের সৌভাগ্য নিয়ে আসবে। সেলিম ভাইকে বলো ওখানে কোন গাইনাকোলজিষ্ট থাকলে নিয়মিত দেখাতে। নইলে লুসাকা চলে এসো। আমি টেইক কেয়ার করবো। টকা পয়সা লাগলেও বলো। সংকোচ করোনা কোন’।
অঞ্জুর জন্ম হলো লুসাকার ইউনিভার্সিটি টিচিং হসপিটালে। যথারীতি সার্বিক তত্বাবধানে কর্মকার দম্পতি। সেলিম কয়েকদিন আগেই ঝুমাকে নিয়ে চলে এসেছিল চিলাঙ্গায়। অঞ্জুর জন্মের পর প্রথম ২১ দিন ঝুমার কাটলো বৌদির আদর যত্নে। দিপালী একবার ঝুমার বান্ধবী, একবার বোন, একবার মা। সেলিম এখন আর অবাক হয়না। ভাবে, এটাই স্বাভাবিক। এরকম কিছু মানুষ আছে বলেইতো পৃথিবীটা আজো টিকে আছে।
দিনে দিনে অঞ্জু বেড়ে উঠতে থাকে। চাহিদা বাড়ে। কোয়াচার চাকরির ইতি টানা অত্যাবশ্যক হয়ে উঠে। সাউথ আফ্রিকার পরীক্ষার প্রস্তুতি জোরেশোরে শুরু করে সেলিম। শুধু সেলিমই নয়, মনু, আজিম, সুব্রত, আলতাফ সহ সবাই। হাসপাতালে রোগী শেষ করে এসে সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি চলে পড়াশুনা। যেন সামনে এমবিবিএস পরীক্ষা। বাকিদের ঘর সংসারের বালাই নেই, চলে যায়। কিন্তু সেলিমের সময় বের করতে হয় ঝুমা আর অঞ্জুর জন্য বরাদ্দ করা সময় কাটছাঁট করে। কিন্তু একা একা রাত জেগে পড়ে কারো পড়াই তেমন এগোয় না। এভাবে পড়লে হবেনা।
একদিন তপন দার সাথে কথা হচ্ছিল মনুর। পরীক্ষা প্রস্তুতির কথা জিজ্ঞেস করলেন।
দাদা, চেষ্টা করছি। কিন্তু এগুচ্ছেনা তেমন। দোয়া করবেন।
বাকিদের কী অবস্থা?
বাকিদেরও একই অবস্থা। সেলিমের অবস্থা হয়তো একটু ভালো। হাসপাতাল থেকে এসে রান্নার ঝামেলা নেই। বউ আছে। আমাদের তো আবার এসে রান্নাও করতে হয়।
এক কাজ করুন। ছুটি নিতে পারবেন?
তা পারবো। সপ্তাহ তিনেক ছুটি হয়তো পাবো। কিন্তু কেন?
আপনারা চার পাঁচ জন ছুটি নিয়ে চিলাঙ্গা চলে আসুন। আমি সেলিমকে ফোন করে দিচ্ছি ঝুমা আর অঞ্জুকে নিয়ে চলে আসতে। বাচ্চাটাকে বেশ কিছুদিন দেখিনা। আপনার বৌদিও বলছিল। এখানে তিন সপ্তাহ দরজা জানালা বন্ধ করে পড়বেন সবাই মিলে। শুধু খাওয়ার সময় পড়ার টেবিল থেকে উঠবেন। ঝুমা এলে দীপালির সময়টাও গল্প করে ভালোই কাটবে।
মনু ইতস্তত করে। কিন্তু জানে তপন কর্মকার নিজের ভাইয়ের আন্তরিকতা নিয়েই বলেছেন, তবুও......
দাদা, আপনাকে আমরা আর কতো জ্বালাবো?
কী যে বলেন! আপনাদের ভাই হলে এইটুকু করতেন না?
রোজার ঈদের পরপরই সাউথ আফ্রিকান মেডিক্যাল কাউন্সিলের পরীক্ষা। লুসাকাতেই সেন্টার। রমজানের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমেই একে একে সবাই এসে হাজির তপন দীপালির বাসায়। অঞ্জুকে কোলে নেয়ার জন্য সুমি আর পুষ্পার কাড়াকাড়ি লেগে গেল। ঝুমার মন ভালো হয়ে যায়। মানসায় মানুষ থাকে কী করে! লুসাকাকে তাও একটু শহর শহর মনে হয়। ঢাকার মতো না হোক। আপাতত কুমিল্লার মতো হলেও চলবে। জানা গেল সেলিম আর মনু রোজা রেখেছিল। ইফতারের ব্যবস্থা হলো। রাতে ডিনারের সময় দীপালি জিজ্ঞেস করলেন কারা কারা রোজা রাখেন। ওদের আবারো বিব্রত হবার পালা। কে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছিলনা। দীপালিই ব্যাপারটা সহজ করে দিলেন।
আমিতো ভোর রাতে উঠবোনা। যারা সেহরি খাবেন তাদের জন্য রান্না করে টেবিলে ঢেকে রেখে যাবো। আপনাদের একটু কষ্ট করে মাইক্রোওয়েভে গরম করে খেয়ে নিতে হবে। আমাদের বাসায় থাকার জন্য যদি আপনারা কেউ রোজা না রাখতে পারেন তাহলে আমার নিজেরই খারাপ লাগবে।
সেলিম ভেবেছিল আর অবাক হবেনা। সেহরির কথায় তাই খুব বেশি অবাক হয়নি। কিন্তু ডিনারের পর যা ঘটলো তাতে অবাক না হয়ে কোন উপায় রইলোনা। দীপালি একটা প্যাকেট থেকে জায়নামাজ বের করে দিলেন। বললেন, ‘আপনাদের দাদা আজ নর্থমিড থেকে কিনে এনেছেন। অবশ্য একটাই এনেছেন। নামাজ যারা পড়বেন একজন একজন করে পড়তে হবে, এই যা’। এর পর কি অবাক না হয়ে পারা যায়! অথচ এই মহিলা নিয়মিত পূজা করেন।
সেলিমের একবার ইচ্ছে হলো উঠে গিয়ে দীপালির পা ছুঁয়ে সালাম করে। মাত্র পাঁচ ফুট লম্বা শরীরে এই মহিলা এতো বিশালতা ধারণ করে আছেন কীভাবে! সৃষ্টিকর্তা বলে আসলেই কেউ একজন হয়তো আছেন। নইলে তপন দা আর বৌদির মতো এমন দুই জন মানুষকে এক ছাদের নিচে মিলিয়ে দেবে কে? সেলিমের আরো মনে হলো সৃষ্টিকর্তার আসলে কোন ধর্ম নেই। তিনি সকল ধর্মের জাতক।
সে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে থাকে। হয়তো পূর্বজন্মে কোন পুণ্য করেছিল। তাই তপন দা আর দীপালি বৌদির সাথে দেখা হয়েছিল।
আগের অংশ
আহমেদ শরীফ শুভ, মেলবোর্ন, অস্ট্রেলিয়া
|