bangla-sydney
bangla-sydney.com
News and views of Bangladeshi community in Australia












এই লিংক থেকে SolaimanLipi ডাউনলোড করে নিন



ছোট গল্প
অতিকায় মানুষ
আহমেদ শরীফ শুভ



দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে সবাই বিরক্ত হয়। তিন তাসের খেলা ততক্ষণে জমে উঠেছে। আজিম, সুব্রত, কাউসার আর আলতাফের চোখ সেলিমের দিকে। সে জিতেই চলেছে। আজিমের লোকসান হয়েছে সবচেয়ে বেশি। তার বিরক্তির মাত্রা স্বাভাবিক ভাবেই বাকিদের চেয়ে অনেক গুন।

ওস্তাদ, আপনারতো কপাল ভালো। ভাবলাম আমাদের পকেট থেকে যা খসিয়েছেন তার কিছুটা উসুল করে নেবো। দেখুন কে আবার এসে খেলার বারোটা বাজিয়ে দিল।

সুব্রত এতো সহজে ছেড়ে দেয়ার পাত্র নয়। বললো, ‘তা হবে কেন? দরজা খুলে দেখুন। যে এসেছে দরকার হলে তাকেও বসিয়ে দেবো। কে আর হবে! মনু ভাই বা ফয়সল ভাই হয়তো এসেছেন ঈদের দ্বিতীয় জামাত সেরে। দরজা খুলেদিনতো আলতাফ ভাই, সেলামীটা আদায় করি।

আজ কোরবানির ঈদ। সেলিম আগেও দেশের বাইরে পরিবারকে ছেড়ে ঈদ করেছে। কিন্তু বাকিদের এই প্রথম। জাম্বিয়া সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে মেডিক্যাল অফিসারের চাকরির ইন্টারভিউ দিতে সবাই লুসাকা এসেছে। ঢাকায় বসেই শুনেছে লুসাকায় গেলেই ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পাওয়া যায়। একবার গিয়ে পৌঁছালেই হলো। দেশে জুনিয়র ডাক্তারদের চাকরির আকাল, সেই সাথে এমন একটা সংবাদ। যারা জানলো তাদের অনেকেই কাল বিলম্ব না করে নাইরোবি হয়ে লুসাকায় পাড়ি জমালো। যারা প্রথম দফায় এসেছিল তারা সবাই ইন্টারভিউ দিয়ে ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে যোগ দিয়ে ফেলেছে দুই সপ্তাহের মাথায়। কিন্তু আজিম, সুব্রত, সেলিম ওরা যখন এলো তখন কী যেন একটা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা হয়েছে, ওয়ার্ক পারমিট হতে নাকি সময় লাগবে চার থেকে ছয় সপ্তাহ। ভাগ্যিস, সবার চাকুরী হয়েছিল। কিন্তু পকেটের টাকাতো ফুরিয়ে আসছে। তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় লুসাকা হোটেলে ওদের ফ্রি থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এটাই নাকি নিয়ম। যারা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের চাকরিতে যোগদানের জন্য অপেক্ষমাণ তাদের সবার জন্য এই ব্যবস্থা। অদ্ভুত নিয়ম বটে! শুধু থাকা খাওয়াই যে ফ্রি তাই নয়। সেই সাথে গেস্টও এলাউড। সেই সুবাদে লুসাকা শহরের যতো বেকার বাঙালি তাদের সবার ডিনার তখন লুসাকা হোটেলে। ভিন্ন মেডিক্যাল কলেজের হলেও সেলিমের সাথে মনুর বন্ধুত্ব আগে থেকেই। দুই বছর পর লুসাকায় দেখা। মনু সৌভাগ্যবানদের একজন। যদিও সেলিমদের মতোই ওয়ার্ক পারমিটের অপেক্ষা করছে, কিন্তু ও বেতন পাবে ডলারে। সেলিমরা যখন আসে তখন জাম্বিয়া সরকারের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে ঘাটতি পড়ে যায়। তাই সরকার থেকে জানানো হয়েছে এখন থেকে যারা যোগ দেবে তাদের বেতন হবে স্থানীয় মুদ্রা কোয়াচায়। ফিরে গিয়ে করবে কী! তার চেয়ে কোয়াচার চাকুরীই ভালো। সবাই রাজি হয়ে যায়। লুসাকা হোটেলে সরকারি অতিথি হিসাবে ফ্রি থাকা খাওয়া, সকাল থেকে মাঝ রাত অবধি আড্ডা মারা, ব্রিজ, থ্রি কার্ডস, নাইন কার্ডস, কাচ্চু এ সব নিয়ে ভালোই কেটে যাচ্ছে।

মনুর সাথে বাকিদের পরিচয় হয়েছে মন্ত্রণালয়ে। জানিয়েছে সে লুসাকা হোটেলে থাকেনা। এখানে তপন দা নামে এক ভদ্রলোক আছেন। চিলাঙ্গা সিমেন্ট কোম্পানির একাউন্টেন্ট। উনার সাথে পরিচয় হওয়ার পর উনিই হোটেল থেকে তাকে বাসায় নিয়ে গেছেন। ভদ্রলোক খুবই অতিথি পরায়ণ। মনু না করতে পারেনি। তা ছাড়া হোটেলের এই আফ্রিকান ঢংয়ে রান্না করা খাবার কতদিন খেতে ভালো লাগে! মনুর প্রতি সবার কেমন যেন একটা ঈর্ষা হয়। একে তো ডলারের চাকরি, তার উপর একজনের বাসায় থাকছে জামাই আদরে।

বরিশালের লোকেরা কথায় কথায় বলে ‘এইয়্যা ম-নু’। তাই বলে ওদের নামও মনু হতে হবে? মানুষতো বাচ্চা ছেলেদের আদর করে ‘মনু’ বলে ডাকে! মনু অবশ্য অনেকটা বাচ্চা ছেলেদের মতোই সহজ সরল আর প্রাণবন্ত। খুব সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারে। সেই সাথে আকর্ণ বিস্তৃত ট্রেডমার্ক হাসি। ওর প্রতি ঈর্ষা জমিয়ে রাখা কঠিন।

সুব্রত ছাড়া বাকি সবাই ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিল স্থানীয় গুজরাটি পাড়া নর্থমিডের মসজিদে। মনুর সাথে দেখে হয়নি। হয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে চিলাঙ্গা থেকে পাবলিক বাসে করে সময় মতো এসে পৌঁছাতে পারেনি। হয়তো দ্বিতীয় জামাত ধরবে। তবে অন্য কিছু স্থানীয় বাঙালির সাথে দেখা হয়েছে। কোলাকুলি সেরে সবাই যে যার মতো ফিরে গেছেন। সেলিম আজিমদের কেউ বাসায় ডেকে নিয়ে যায়নি। আজিম একটু অবাক হয়েছিল। সেলিম সান্ত্বনা দিয়েছে।

ধুর! এইগুলো নিয়ে মন খারাপ করোনা। বিদেশে এলে বাঙালিদের অনেকেই এমন সেলফ সেন্টারড হয়ে পড়ে। হয়তো ভাবছে বেকারদের বাসায় ডেকে নিয়ে কী হবে। হয়তো ভাবছে আমরা তাদের সোসাইটিতে বিলং করিনা।

তাই বলে ঈদের দিনেও? আর আমরাতো বেকার নই। পোষ্টিংয়ের জন্য অপেক্ষা করছি মাত্র।

বাদ দাওতো এই সব চিন্তা। তার চেয়ে চলো রুমে গিয়ে তিন তাস নিয়ে বসি। লাঞ্চের মেন্যুতে বিফ স্টেক বা টি-বোন থাকলেই হলো, একটা কোরবানি কোরবানি ভাব চলে আসবে।

কী আর করা! নামাজ শেষে সবাই ফিরে এসেছে ৩১৫ নম্বর রুমে। মুখ্য আড্ডাবাজ হিসাবে এর মধ্যেই সেলিমের পরিচিতি হয়েছে। সুতরাং আড্ডা তার রুমে জমবে সেটাই স্বাভাবিক।

দরজা খুলতেই দেখা গেল আকর্ণ বিস্তৃত ট্রেড মার্ক হাসি নিয়ে মনু হাজির। পেছনে একজন অপরিচিত ভদ্রলোক। মনু পরিচয় করিয়ে দিল। উনার কথাই এতদিন বলে এসেছি। তপন দা। উনি নিজেই সবার সাথে হাত বাড়িয়ে পরিচয় করলেন। ঈদের কোলাকুলি সারলেন।

আমার নাম তপন কর্মকার। চিলাঙ্গা সিমেন্টে চাকরি করি। মনুর কাছে আপনাদের কথা শুনেছি। আপনাদের ঈদ মুবারক জানাতে এলাম।

ঈদ মুবারক দাদা। আমরাও আপনার কথা অনেক শুনেছি। আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুব ভালো লাগছে। প্লিজ বসুন। রুম-বয়কে ডেকে ড্রিঙ্কস দিতে বলছি।

না, না। ড্রিঙ্কস লাগবেনা। আপনারা আমার সাথে চলুন। আমাদের সাথে ঈদ করবেন।

ঈদ? আপনাদের সাথে? ঈদে তো বরং আমাদেরই উচিত আপনাদের আপ্যায়ন করা। বরং আমাদের সাথে লুসাকা হোটেলে রাতে ডিনার করুন।

আপনাদের বৌদি আমাকে পাঠিয়েছে। মনুর কাছে আপনাদের কথা শুনে ঈদের রান্না করেছে। আপনারা বাবা মা ভাই বোন ছেড়ে ঈদ করছেন। আমরা লুসাকাতে থেকেও আপনাদের হোটেলে বসে ঈদ করতে দেবো এটা কী করে হয়!

প্রথমে সবাই একটু অবাক হলেও ভদ্রলোকের কথায় বেশ আন্তরিকতা আছে। মনুও তাড়া দিল। সত্যিইতো, পোলাও মাংস সেমাই জর্দা ছাড়া এ কেমন ঈদ! তপন দার নিমন্ত্রণ পেয়ে মনে হলো ঈদটা তাহলে একেবারে নিরান্দ কাটাবেন। তপন কর্মকার তার নাইন সিটার নিয়ে এসেছিলেন। সবাই গাড়িতে উঠলো। লুসাকা হোটেল থেকে চিলাঙ্গা, ৩০ মিনিটের ড্রাইভ।

গাড়ি থেকে নামতেই সবার অবাক হবার পালা। দীপালি কর্মকার দুই মেয়েকে নিয়ে এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানালেন। বাড়ির আঙ্গিনায় একটা ছাগল বাঁধা আছে দেখা গেল। তপন জানালেন ঈদে জবাই করা হবে বলে গতকালই কিনে আনা হয়েছে। এই বাসায় তিন বা নয় কার্ড খেলা হয়না বটে। কিন্তু বাজি ধরে ব্রিজ খেলা হয়। পরশু রাতে এমনই খেলা হয়েছে। এক দিকে মনু আর তপন দা। প্রতিপক্ষ রতন আর আসিফ। ওদের সাথেও পরিচয় হলো। দু’জনই সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। দু’মাস হলো লুসাকায় এসে প্রাইভেট ফার্মে চাকরি নিয়েছেন। উভয়ই বিবাহিত। কিন্তু ফ্যামিলি নিয়ে আসেননি এখনো। প্রবেশনারি পিরিয়ড শেষ হলে নিয়ে আসবেন। আপাতত তপন কর্মকারের অতিথি। ব্যাঙ্কে টাকা উঠাতে গিয়ে পরিচয়। দু’জনের শত আপত্তি আর দ্বিধার মুখে প্রায় জোর করেই হোটেল থেকে ধরে বাসায় নিয়ে এলেন।

পরশু রাতের খেলার বাজি ছিল একটা ছাগল। যারা হারবে তারা একটা ছাগল কিনে আনবে আর তা কোরবানি করা হবে ঈদের দিনে। এটাই ছিল ডিল। জিত হলো মনু আর তপনের। রতন একটা ৫০০ কোয়াচার নোট বের করে তপন কর্মকারের ড্রাইভার বান্ডাকে দিয়েছিল ছাগলটা কিনে আনতে। কোরবানিটা তো অন্তত হবে। কিন্তু কার নামে? এক ছাগল তো আর বহু নামে কোরবানি হতে পারেনা! আসিফ জবাই করায় সিদ্ধহস্ত। সে ছাগলটা জবাই করবে। সুতরাং তার নামে কোরবানি করা হবেনা। মনুর নামে হতে পারে। সেতো বাজিতে জিতেছে। এই ছাগলের আইনগত মালিক সে আর তপন দা। কিন্তু তপন দা তো হিন্দু। তাই শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো ছাগলটা শেষ পর্যন্ত মনুর নামেই আত্মদান করবে। বাজির টাকায় কোরবানি করা জায়েজ কিনা এই প্রশ্নটা অবশ্য একবার মনুর মাথায় এসেছিল। ধুর! এই সব ভেবে কী হবে!

আর দেরি করা যায় না। এখনই জবাই না করলে রান্না সেরে দুপুরের খাবার খেতে বিকেল গড়িয়ে যাবে। আসিফ মনু আর রতনকে সঙ্গে নিয়ে ‘আল্লাহু আকবর’ বলে ফেললো। ড্রাইভার বান্ডা এসে হাত লাগিয়ে চামড়া ছাড়িয়ে দিল নিমিষেই। দীপালি তখন অন্য রান্না শেষ করে চুলায় মাংস চড়ানোর অপেক্ষায়। হিন্দু রাড়িতে কোরবানির রান্না! সেলিমের অবাক হবার পালা শেষ হয়না। এমন কিছু সে জীবনে দেখেওনি, শুনেওনি।

সবাই মিলে ঘুরেঘুরে বাড়িটা দেখে। তেমন গোছানো না। আর গোছানো হবেই বা কী করে! গৃহকর্ত্রী সারাদিন কাটান রান্নাঘরে। গৃহকর্তা সারাদিন অফিসে। অফিসে শেষে ফেরার পথে প্রায়ই অতিথি ধরে নিয়ে আসেন বিভিন্ন হোটেল আর অফিস থেকে। তাদের কেউ কেউ আবার দিনের পর দিন বাসার বিভিন্ন রুম ব্যাবহার করেন ট্যাম্পোরারি একোমোডেশন হিসাবে। কিছু প্রতিমাও দেখা গেল। লক্ষ্মী, সরস্বতী এবং গণেশকে চেনা গেল। এই বাড়িতে তা হলে অন্তত একজন প্র্যাকটিসিং হিন্দু আছেন। তিনি নিশ্চয়ই দীপালি। সুমি আর পুষ্পাও সায় দিল। মা প্রতিদিন পূজা করেন। অথচ এই মহিলাই পরম আনন্দে কোরবানির মাংস রান্না করছেন। সেলিমের অবাক হওয়া শেষই হয়না। কিন্তু সে জানেনা এটা তার অবাক হওয়ার শুরু মাত্র।

জানা গেল রান্না শেষ হতে দুইটা বেজে যাবে। টেবিলে সেমাই, জর্দা, পায়েস আর কোক এলো। এই না হলে ঈদ! সেলিম যদি লেখক হতো তাহলে হিন্দু বাড়িতে ঈদ করা নিয়ে একটা স্মৃতিকথা অন্তত লিখতে পারতো। শুধু এই গল্পটা লেখার জন্য হলেও তার লেখক হতে ইচ্ছে করছে। তপন জানালেন তাকে অফিসে একটু হাজিরা দিয়ে আসতে হবে।

আপনারা নাস্তা সেরে কয়েক দান ব্রিজ সেরে নিন। আমি লাঞ্চের আগেই ফিরে আসছি। সুমি, মা! আঙ্কেলরা কোন গান শুনতে চায় দেখো। ক্যাসেট প্লেয়ারটা ছেড়ে দাও।

লাঞ্চের টেবিলে আরেক বার অবাক হবার পালা। কী নেই! পোলাও, খিচুড়ি, কোরবানির ছাগল (খাসি নাকি পাঁঠা তা জেনে কাজ কী!), চিকেন রোষ্ট, কোর্মা, মাছের কাবাব, চিংড়ির মালাইকারি। মহিলা এতো কম সময়ে এতো কিছু রান্না করলেন কী করে! আহা, কতদিন পর দেশি খাবার। শুধু লাঞ্চই না, ডিনারও সেরে আসতে হলো। ওদের অস্বস্তি লাগছিল। কিন্তু দীপালি নাছোড় বান্দা।

যেতে দিলেইতো! আপনাদের দাদা যদি আপনাদের হোটেলে না রেখে আসেন তাহলে যাবেন কী ভাবে? রাতে হবে খাসির পায়ার নেহারী। তার আগে আপনাদের ছাড়ছে কে? নিজের মা বা বোনকে ছেড়ে যেতে পারতেন ঈদের দিন?



পরের অংশ






Share on Facebook               Home Page             Published on: 26-May-2019

Coming Events:



A day full of activities, games and fun.







Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far





Lakemba Blacktown Mascot
Minto Money raised so far



Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far







Blacktown Lakemba Mascot
Minto Money raised so far